বন্যাদুর্গতদের জন্য সবাইকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে

সাগরে গভীর নিম্নচাপজনিত বৃষ্টিপাত, মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাত এবং ভারতের উজানের ঢলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে তাতে এরই মধ্যে ১৩টি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে প্রায় চল্লিশ লাখেরও বেশি মানুষ। হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে বন্যায় মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সবকিছু তলিয়ে গেছে পানির নিচে। কোথাও কোথাও নদীসংলগ্ন এলাকায় এত বেশি স্রোত বইছে যে ঘরবাড়ি সে স্রোতে অবলীলায় ভেসে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে যে- এ পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
অভিযোগ ওঠেছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুরু ও গজলডোবা বাঁধ খুলে দেওয়ার দরুন প্রবল পানির স্রোতে বাংলাদেশের ১৩টি জেলায় এই আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে এই বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয় নিয়ে কঠোর সমালোচনাও করা হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় কুমার ভার্মার কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি জানিয়েছেন- গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো গেট খুলে দেওয়া হয়নি। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলাধারটির সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ৯৪ মিটার। জলস্তর এর বেশি উঠলেই নিজের থেকেই জল গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবে। পানিস্তর আবার নিচে নেমে গেলে নিজের থেকেই গেট বন্ধ হয়ে যাবে। পানিস্তর সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার বেশি হয়ে যেতেই জলাধারের দুটি গেট দিয়ে জল বেরোচ্ছে।
বলা বাহুল্য, পানির অস্বাভাবিক চাপে যদি গেট খুলে দেওয়া হয়ও তাহলে তার আগে ভাটির দেশকে অন্তত অবহিত করা উচিত ছিল ভারত সরকারের, যাতে নিকটবর্তী দেশের অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভারত গেট খুলে দেওয়ার আগে বাংলাদেশকে কোনোভাবেই বিষয়টি অবহিত করেনি। এটা নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সাধারণ নিয়মকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতের এই ভূমিকা অর্থাৎ এই অসৌজন্যমূলক আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। ইতোমধ্যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনও করছে।
দেশের অন্তত ১৩ জেলায় ক্রমাগত এমন বন্যা পরিস্থিতিতে শঙ্কা করা হচ্ছে দেশের উত্তরের জনপদকে নিয়েও। তিস্তা নদীর ওপরে নির্মিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়া সেই শঙ্কা যেন আরও বেড়ে গেছে। সেখানেও নতুন করে আবার বন্যা দেখা দেয় কি না সেটা নিয়ে সে অঞ্চলের মানুষ রয়েছে আতঙ্কের মধ্যে। তবে আপাতত দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ১৩ জেলায় যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে সেটাই এখন সরকারসহ সকল মানুষের মাথা ব্যথার কারণ। কীভাবে বন্যাক্রান্ত এত বিপুল সংখ্যক মানুষের নিরাপদ আশ্রয় ও তাদের খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিপত্রের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে, সেটাই এখন ভাবনার বিষয়। এই সময়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় একদিকে মানুষের ঘরবাড়ি যেমন ডুবে গেছে, অন্যদিকে রাস্তাঘাটও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে এবং ফসল পানির নিচে চলে গেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এছাড়াও এই বিশাল অঞ্চলের যত মাছ চাষের পুকুর ছিল তার সবই পানিতে তলিয়ে গেছে এবং সেখানকার বিপুল পরিমাণ মাছও বন্যার স্রোতে বেরিয়ে গেছে। জানা যায়, এখন গোমতী নদীর পানি বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপরে রয়েছে। এই সময়ে যদি বাঁধগুলোও কার্যকর থাকতো, তাহলে বর্তমানের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। আসলে প্রয়োজন ছিল বাঁধগুলো বন্যা প্রতিরোধে সক্ষম কি না তা নিশ্চিত করার। প্রতি বর্ষার শুরুতেই কর্তৃপক্ষের দেশের সব অঞ্চলের সব বাঁধ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আর অতীত ইতিহাস বলে আগস্ট মাসে বন্যা হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর এই বন্যা শুধু একবার নয়- পরপর কয়েকবার হতে পারে। ২০২৪-এর বর্ষাকালে দেখা গেল সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ কোনো কোনো অঞ্চল চারবারও বন্যাক্রান্ত হয়েছে।
এবারের নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলের বন্যা একেবারেই আকস্মিক। এখানে সাধারণত এত ভয়াবহ বন্যা কখনো হয় না। এ অঞ্চলের বয়স্ক মানুষরা বারবার এটাই বলছে যে- গত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আমাদের এই অঞ্চলে এ ধরনের বন্যা হয়নি। এত পানির স্রোত আমরা কখনো দেখিনি। আর এবারের এই অঞ্চলের বন্যায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাঁধ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে। তারা কেন অবিবেচকের মতো বাংলাদেশকে না জানিয়ে এই বাঁধ খুলে দেবে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো- বাঁধগুলো খুলে দেওয়ার আগে ভারত বাংলাদেশকে আগাম নোটিশ তো দিতে পারতো। তাহলে যেসব অঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে তারা সাবধানতা অবলম্বন করতে পারতো। এর আগে দিনাজপুরে এমন একটি ইতিবাচক পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। সেখানে ভারত কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়ে দিনাজপুর জেলা প্রশাসককে আগে থেকেই জানিয়েছিল। কিন্তু এবার তারা এটা কেন করেনি তা বোধগম্য নয়।
আসলে পাশাপাশি দুটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর ওপর একটি দেশ কখনোই ব্যারেজ নির্মাণ করতে পারে না। এটা হলো সবচেয়ে মৌলিক কথা। আলো, বাতাস ও পানি- এই তিনটি হলো প্রকৃতির অশেষ দান। এই তিনটি প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর কোনো দেশই কর্তৃত্ব ফলাতে পারে না। যখন পানি বাড়বে তখন সবদেশেই পরিস্থিতি অনুযায়ী বাড়বে। আবার যখন পানি কমবে তখন সব দেশেই একই পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পানি কমবে। এটাই নিয়ম হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখে আসছি ভারত ফারাক্কা বাঁধসহ অনেকগুলো বাধঁ তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি বঞ্চিত করছে। আবার তাদের সুবিধা অনুযায়ী পানি বেশি হলে তা বাংলাদেশের দিকে ছেড়ে দিয়ে আকস্মিক বন্যার কারণ ঘটাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে পাশাপাশি দুইটি বন্ধপ্রতীম দেশের মধ্যে এই স্বার্থহানীর বিষয়টি চলতে পারে না। বাংলাদেশের উচিত এই বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করা। তবে যেটাই হোক, বন্যার একমাত্র কারণ অবশ্য এই বাঁধ খুলে দেওয়াই না, অতিবৃষ্টিও মূল কারণ। এছাড়া আমাদের নিজেদের দুর্বলতাগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে, যাতে আমাদের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকে। আরো একটি কারণকেও আমরা উপেক্ষা করতে পারি না; সেটা হলো- বন্যার আগমন ঘটে এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় আমাদের নদীগুলো নাব্য না থাকার কারণে। পলি জমতে জমতে প্রায় সকল নদীর তলদেশই ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষার ও উজানের ঢলের পানি নদী দিয়ে নামতে পারে না, তখন নদীর দুই পাড়ে থাকা জনবসতি ও ফসলি জমি ভাসিয়ে পানি সাগরে যায়। তাই নদীগুলো নাব্য করার উদ্যোগ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
আর আমরা এটা তো অস্বীকার করতে পারি না যে- ভারত বাঁধ খুলে পানি ছাড়ার আগেই বন্যাদুর্গত অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাগরে গভীর নিম্নচাপজনিত টানা বর্ষণ। প্রকৃতপক্ষে, এই বৃষ্টি এবং বন্যার আশঙ্কার কথা বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই আবহাওয়া অফিসের নিশ্চয়ই জানা ছিল। কিন্তু আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে এর কোনো পূর্বাভাস জারি করা হয়নি। জনগণকে আবহাওয়া বিষয়ক সতর্ক করা আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রাথমিক দায়িত্ব কিন্তু কেন তা সময় মতো করা হয়নি তার জন্য অবশ্যই তাদের জবাবদিহিতা থাকা উচিত।
বলার অপেক্ষা রাখে না- ফেনী এবং অন্যান্য অঞ্চলের বর্তমান প্রজন্ম এর আগে এমন একটিও বন্যা দেখেনি। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনীর তিনটি উপজেলা। এগুলো হচ্ছে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা। এসব উপজেলার রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। দেড় মাস আগেও বন্যায় এই জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আমি মনে করি, বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে সাধারণ মানুষকে বন্যা সম্পর্কে সতর্ক করা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় সম্পর্কে জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল সংশ্লিষ্টদের। সেখানকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। সরকারের পানি নিষ্কাশনসহ বন্যাক্রান্ত অবস্থা থেকে কী করে দ্রুত উদ্ধার পাওয়া যায় এখন সে ধরনের অবকাঠামোর দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে উচিত নদীর প্রবাহের মানচিত্র তৈরি করা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে চিহ্নিত করা যেখানে বাড়ি বা অবকাঠামো নির্মাণ এড়ানো যেতে পারে, যাতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়।
এখন এই অবস্থায় সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা বজায় রাখা। মানুষ এই অবস্থায় তাদের কোনো আত্মীয় স্বজনের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছে না। দুর্যোগের সময় মোবাইল অপারেটরদের উচিত নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সেবা নিশ্চিত করা। জানা গেছে, বন্যাদুর্গত এলাকায় বর্তমানে মোবাইল নেটওয়ার্ক একেবারেই বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এই বিষয়টি এখন আরো বেশি পীড়া দিচ্ছে সবাইকে। এমনকি নিরবচ্ছিন্ন মোবাইল ফোনের নেওয়ার্ক না থাকার দরুন সাহায্যকারীদের ত্রাণতৎপরতাও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এখন যেটা সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সেটা হলো- বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার কার্যক্রমগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়া। সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং খণ্ড খণ্ডভাবে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন দল এখন বন্যাদুর্গতদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বটে তবে এই মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর সব ফায়ার ব্রিগেড মোতায়েন করা উচিত। শিশুদের উদ্ধার করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সর্বোপরি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা উচিত বন্যাদুগর্ত এলাকার জন্য।
কিছুটা হলেও আশার কথা যে- বর্তমান বন্যা পরিস্থিতিতে সহায়তা করতে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছেন। অনেক নৌযানও সরবরাহ করার চেষ্টা করছে তারা। খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দিতে বন্যাদুর্গত এলাকায় সাধারণ মানুষের বিভিন্ন দল চলে গেছে। তাঁরাই মূলত প্রমাণ করছে মানুষ মানুষেরই জন্য। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে সাধ্যমতো অংশ নিয়েছেন। এখন যে কথাটি মনে রাখতে হবে, তা হলো- পানি সরে যাওয়ার পর পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে। এ বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে।আনিসুর রহমান খান: কলাম লেখক, কবি ও সংগঠক

মন্তব্য করুন