সাংবাদিক নির্যাতনে শাস্তি পাওয়া সেই আরডিসি নাজিম উদ্দিন ইটনার ইউএনও
কুড়িগ্রামের এক সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় তৎকালীন রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিনকে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার কাউছার হামিদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে ইটনার ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হয়। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার এক আদেশে তাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হয়েছিলো। সেখান থেকে পরে ইটনায় বদলি করা হয়।
২০২০ সালের মার্চে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে মধ্যরাতে তার বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে জেলা প্রশাসনের তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনায় বিভাগীয় শাস্তির মুখেও পড়েছিলেন নাজিম উদ্দিন। ওই ঘটনায় ফৌজদারী অপরাধে আদলাতে মামলাও হয়েছে।
আরিফুল ইসলাম রিগান অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি।
রিগ্যানের আইনজীবী বলছেন, আইনের দৃষ্টিতে পলাতক আসামিকে ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা সম্পূর্ণ বেআইনি। এমন সিদ্ধান্ত আদালত অবমাননার শামিল।
কুড়িগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নামে সরকারি পুকুরের নামকরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফকে তার শোবার ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে যান জেলা প্রশাসনের কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট ও আনসার সদস্যরা।
তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে আরিফকে পেটাতে পেটাতে গাড়িতে তুলে জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে ধরলা নদীর তীরে ক্রসফায়ারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ। পরে সেখান থেকে ফিরিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়।
আরিফের ঘরে আধা বোতল মদ ও দেড়শো’ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে রাতেই কারাগারে পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে একদিনের মাথায় জামিনে মুক্তি পান আরিফ। পরে তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীন, আরডিসি নাজিম উদ্দিন, এনডিসি রাহাতুল ইসলাম ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমাকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় অভিযোগে তদন্ত শুরু করে।
অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) স্থগিত, এনডিসি রাহাতুল ইসলামের তিনটি ইনক্রিমেন্ট কর্তন এবং আরডিসি নাজিম উদ্দিনকে নিম্নধাপে নামিয়ে দেওয়া। এছাড়া রিন্টু বিকাশ চাকমাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে তারা রাষ্ট্রপতির কাছে দাপ্তরিক দায়মুক্তি নিয়ে চাকরিতে বহাল রয়েছেন।
পরে এ ঘটনায় নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক আরিফ কুড়িগ্রাম সদর থানায় অভিযোগ করলে সে বছর ৩১ মার্চ হাইকোর্টের নির্দেশে ডিসি সুলতানা পারভীন ও আরডিসি নাজিমসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও নির্যাতনের অভিযোগে মামলা রেকর্ড হয়। গত ৪ বছরেও সেই মামলা আলোর মুখ দেখেনি।
মামলাটি বর্তমানে রংপুর পিবিআইয়ের কাছে তদন্তাধীন। গত চার বছরে ওই মামলার কোনো আসামি আদালতে আত্মসমর্পণও করেনি। বরং আইন-আদালতকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে’ তাদের প্রত্যেককেই বিভিন্ন দায়িত্বে পোস্টিং দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ফৌজদারি মামলা চলমান থাকার পরও আসামিদের পোস্টিংয়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের একটি আইনি নোটিশ দেওয়া হয়। সে নোটিশের জবাব না পাওয়ায় ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন আরিফুল ইসলাম রিগ্যান।
আরিফের আইনজীবীরা জানান, ডিসি সুলতানা ও অপর তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলমান। সে মামলায় তারা এখনো জামিন নেননি। ফলে আইনের দৃষ্টিতে তারা এখনো পলাতক। ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে বরখাস্ত না করে তখন এক আসামিকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল, যা আইন বহির্ভূত। সে কারণেই হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়।
ওই রিটের শুনানি নিয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন এনডিসি রাহাতুল ইসলামকে দেওয়া পোস্টিং কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ডিসি সুলতানাসহ একই মামলার অপর তিন আসামিকে সেসময় পোস্টিং না দেওয়ার বিষয়ে বিরত থাকতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতেও রুল জারি করেন আদালত।
এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব রুল জারি করেন। কিন্তু বিবাদীরা রুলের জবাব না দিয়ে আদালতকে উপেক্ষা করে একে একে চার আসামিকেই পোস্টিং দেয়। সেসময় নাজিম উদ্দিনকে সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হয়। সর্বশেষ তাকে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ইউএনও হিসেবে পদায়ন করা হয়।
এ বিষয়ে আরিফের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু গণামধ্যমকে বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার আসামি ও উচ্চ আদালতের রুল থাকার পরও এভাবে পোস্টিং দেওয়া আইন ও বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। এটা নিশ্চিত যে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আসামির সঙ্গে যোগসাজশে সরকারের কাছে তথ্য গোপন করে পোস্টিং দিয়েছে। আমরা বিষয়টি আদালতের নজরে আনব।’
আইন আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এভাবে একজন আসামিকে ইউএনওর মতো পদে পোস্টিং দেওয়া আইনের শাসনের পরিপন্থি।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘নাজিম উদ্দিনের মতো ব্যক্তি সবসময় সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করার দাবি জানাই।’
ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও ইউএনও হিসেবে পদায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘তাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ইউএনও হিসেবে পদায়ন করার পর আজকে ইটনা আবার বদলি করা হয়েছে। আমার জানা ছিলো না এই সেই নিজাম উদ্দিন। তবে তাকে প্রত্যাহারের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের।’
এ বিষয়ে নাজিম উদ্দিন বলেন, বিভাগীয় যে মামলা হয়েছিল তা ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে এ সংক্রান্তে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না তা জানা নেই।
(ঢাকাটাইমস/০৮সেপ্টেম্বর/এসআইএস)