নিজস্ব সিন্ডিকেটকে কাজ বাগিয়ে দিতেন তিনি
নিজস্ব সিন্ডিকেটকে কাজ বাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জামালপুর পৌরসভার মেয়র ছানোয়ার হোসেন ছানুর বিরুদ্ধে। এ কাজ করতে তার আয়ত্তের বাইরের ঠিকাদারদের লাইসেন্স নবায়ন করতেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হওয়াসহ বঞ্চিত হয়েছেন ৩৯৫ ঠিকাদার। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে মেয়র গড়ে তুলে ছিলেন একটি নিজস্ব বাহিনী। অভিযোগ ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের।
এসব ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। এদিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন পৌরসভার প্রশাসক।
পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জামালপুর পৌরসভায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ঠিকাদারি লাইসেন্স ছিল ৩৭৬টি। পরে ২০২১ সালে নির্বাচনের পর মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানু দায়িত্ব নিয়ে আরও ৩৪টি নতুন লাইসেন্স প্রদান করেন। এতে লাইসেন্সের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪১০ টিতে। কিন্তু ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে শুধুমাত্র ২১টি লাইসেন্স নবায়ন করেন তিনি। বাকি ৩৮৯টি লাইসেন্স নবায়ন করেননি। প্রতিটি লাইসেন্স নবায়ন করতে দুই হাজার ৩শ টাকা সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দিতে হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী লাইসেন্স নবায়ন না করার সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে আট লাখ ৯৪ হাজার ৭শ’ টাকা। পরবর্তী অর্থবছরে আরও ৬টি লাইসেন্স কমিয়ে ১৫টি লাইসেন্স নবায়ন করেন মেয়র। এর মধ্যে মেয়রের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান অমিতের মেসার্স এ এম এন্টারপ্রাইজ, মোফাখখারুল ইসলাম লিখনের এস এল এন্টারপ্রাইজ, মেয়রের দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত নূরে আলম জিকুর এ আরআর এন্টারপ্রাইজ, মেয়রের ঠিকাদারি ব্যবসার পার্টনার আশরাফুল ইসলাম সিদ্দিকী মামীমের মামীম এন্টারপ্রাইজ, ফুরকানুল আলম রিপনের রিপন এন্টারপ্রাইজ, আব্দুল আজিজের জেনি এন্টারপ্রাইজ ও মন্জুয়ারা বেগমের সাউথ এন্টারপ্রাইজ অন্যতম। ওই অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করেছে নয় লাখ ছয় হাজার দুইশ টাকা।
পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানু দায়িত্বে থাকাকালীন তার নিজস্ব সিন্ডিকেটকে কাজ বাগিয়ে দিতেই সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করেছেন ১৮ লাখ ৯শ’ টাকা।
বঞ্চিত করেছেন মেসার্স আর জে এন্টারপ্রাইজ, জেবি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স তিতাস কন্সট্রাকশন, মেসার্স আলিফ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ফিরোজ ট্রেডলিঙ্ক ও মেসার্স তামান্না এন্টারপ্রাইজসহ ৩৯৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।
বঞ্চিত ঠিকাদাররা অভিযোগ করে বলেন, মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানু ঠিকাদারি কাজ করার জন্য নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। সেই বাহিনীর ভয়ে কেউ লাইসেন্স নিয়ে কথা বলার সাহস করেননি। পৌরসভার সকল কাজ তার ওই বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের দাপটে দলীয় নেতাকর্মীরাও কাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
মেসার্স জেবি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ঠিকাদার মো. আনিছুর রহমান মুকুল বলেন, পৌরসভার মেয়র ছানোয়ার হোসেন ছানু দায়িত্ব নেওয়ার পরে কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও আমাদের লাইসেন্স নবায়ন করেননি। লাইসেন্স নবায়ন করার জন্য পৌরসভায় গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি লাইসেন্স নবায়ন হবে না বলে জানিয়ে দেন। তখন তার বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ সাহস পায়নি।’
ঠিকাদার মো.মনিরুল ইসলাম বিপ্লব বলেন, ‘মেয়র আমাদের লাইসেন্স নবায়ন করেননি। তিনি শুধু নিজস্ব কয়েকটি লাইসেন্স নবায়ন করেছেন। আমরা কয়েকজন ঠিকাদার পৌরসভায় গিয়ে কথা বলেছি। আমরা একটা দরখাস্ত দেব।’
মেসার্স আলিফ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার লাইসেন্সের বয়স নয় বছর। আমি লাইসেন্স করার পর অনেক টাকার শিডিউল কিনেছি। কিন্তু পৌরসভার একটা কাজও পাইনি। তিনি ক্ষমতায় আসার পর আমার লাইসেন্স নবায়ন করেননি। আমরা সাধারণ মানুষ, ব্যবসা করে খাই। কোনো কিছু বলতে পারি নাই।
এ বিষয়ে জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘ব্যক্তি স্বার্থের কাছে এদের রাষ্ট্র এবং সরকারি স্বার্থ ছিল নগণ্য। তাই রাজস্ব আসলো কি আসলো না, এটা দেখার ছিল না। কোটি কোটি টাকা নানাভাবে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরই ধারবাহিকতায় ঠিকাদারি লাইসেন্স নবায়ন না করা এবং নিজেদের কিছু লোকদের মাধ্যমে কাজ করার জন্য গুটি কয়েক লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।’
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও পৌরসভার প্রশাসক শীতেষ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘এ বিষয়টি জানা ছিল না। আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উল্লেখ, মেয়র মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন ছানু ২০২১ সালের ২৪ মার্চে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মেয়র আত্মগোপনে চলে যান। গত ১৮ আগস্ট তিনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান। পরে সরকারি নির্বাহী আদেশে পৌরসভার দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।
(ঢাকাটাইমস/১৫সেপ্টেম্বর/পিএস)