হাসান মেহেদী হত্যার দুই মাস
‘বাবা তো মরে গেছে, কবে আসবে?’
‘দাদা এসেছে, বাবা তো এলো না; বাবা কেন আসছে না, কবে আসবে’- গ্রাম থেকে আসা দাদাকে সামনে পেয়ে এমন প্রশ্ন ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদীর মেয়ে নিশার। ছোট্ট এই শিশুর কাছে মৃত্যু মানে আর না ফেরা নয়, তাই প্রতিক্ষণ তার বাবার অপেক্ষা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গত ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজলা ঢালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন এই সাংবাদিক।
ছেলে হত্যার বিচার চাইতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যান মেহেদীর বাবা মোশাররফ হোসেন। সেখানেই দাদার সঙ্গে দেখা মেহেদীর বড় মেয়ে নিশার।
মেহেদী স্ত্রী ফারহানা ইসলাম জানান, বেশ কিছুদিন পর দাদার সঙ্গে দেখা নিশার। দাদাকে দেখেই মেয়ের প্রশ্ন- দাদা এসেছে, বাবা তো এলো না! বাবা আসে না কেন? কবে আসবে?’
‘মেয়ে জেনেছে বাবা মারা গেছে, তার মনে গেঁথে আছে বাবা অন্য কোথাও গেছে, আসবে একদিন। তাকে বুঝাতেই পারি না।’ বলেন ফারহানা।
ফারহানার সঙ্গে মঙ্গলবার কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দুই মাস হলো মেহেদী নেই। একটা অদ্ভুত কষ্টের ঘোরের মধ্যে যাচ্ছে দিন। তিনি বলেন, ‘আট মাসের ছোট মেয়েটার তো কথা ফোটেনি, তবে ‘আবু আবু’ করে। এভাবেই সে বাবাকে ডাকত। সাড়ে তিন বছরের মায়মুনা বিনতে নিশা অস্থির বাবার অপেক্ষায়। বাবা কবে আসবে। এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।' বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন ফারহানা।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের এক সাধারণ পরিবারের সন্তান মেহেদী হাসান তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। তাই দায়িত্বও ছিল বেশি। মেহেদীর মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার। মা-বাবার চিকিৎসার পাশাপাশি মেহেদীর স্ত্রী ও দুই মেয়ে এবং ছোট দুই ভাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সবাই।
স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকতেন হাসান মেহেদী। তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন পটুয়াখালীর বাউফলে। স্ত্রী ও সন্তানরা ঢাকাতেই আছে। পটুয়াখালীতে থাকে মেহেদীর মা-বাবা আর ছোট ভাই মেজবা উদ্দিন কাইফ।
কিশোর কাইফের সঙ্গেও কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের সংসার আর তার লেখাপড়া কীভাবে চলবে দুশ্চিন্তায় এই কিশোর।
মেহেদীর বাবা জানান, মেহেদীর মা মাহমুদা বেগম সারা দিন পাগলের মতো করেন মেহেদীর জন্য। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় থাকতে বাসা থেকে ওর মা বের হয়ে সেই যাত্রাবাড়িতে ওভারব্রিজের নিচে গিয়ে বসে থাকত; যেখানে মেহেদী মারা যায়। ওভারব্রিজের নিচে গিয়ে মেহেদীকে খোঁজে।’
হাসান মেহেদীর মরদেহ গত ২০ জুলাই সকালে পটুয়াখালীর বাউফলে দাফন করা হয়। মেহেদীর বাবা মো. মোশাররফ হোসেনের হার্টে ব্লক (করোনারি ধমনীতে ব্লক) আছে, চারবার তিনি স্ট্রোক করেছেন। মোশাররফ হোসেনের মেজ ছেলে থাকেন গাজীপুরে। পরিবারের মূল ভরসা ছিল মেহেদী। ভাইদের পড়ালেখার দায়িত্ব, বাবা-মায়ের খরচ, ঢাকা শহরে দুই সন্তানসহ পরিবারের খরচ সবটাই সামলাতেন মেহেদী। তার সীমিত আয়ের মধ্যেই সবকিছু করার চেষ্টা করতেন।
হাসান মেহেদীর নিহত হওয়ার পর বিভিন্ন পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছে তার পরিবার। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আর্থিক সহায়তার আবেদন দিতে চান বাবা মোশাররফ হোসেন।
গত রবিবার ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও প্রায় ৩০ জনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার আবেদন করেন মেহেদীর বাবা। আদালত মামলার তদন্ত এবং আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।
(ঢাকাটাইমস/১৮সেপ্টেম্বর/মোআ)