সিল ভাড়া নিয়ে হাজারী গুড় তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন গাছিরা

প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ। সন্ধ্যা-সকাল কুয়াশার চাদর মুড়ে দিচ্ছে চারপাশ। ঘাসের ডগায় দেখা মিলছে শিশিরবিন্দু। সেই শীতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে খেজুর রসের। আর এই খেজুর রস থেকেই তৈরি হয় মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়। তাই খেজুরের পাটালি গুড় এবং হাজারী গুড় তৈরির জন্য গাছ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা।
হাতে দা, বাটাল, নিয়ে ও কোমরে দড়ি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাঁচা-ছোলা ও নলি বসানোর কাজ করছেন গাছিরা। কয়েকদিন পরেই গাছে বাঁধানো হবে হাঁড়ি। এরপর চলবে রস সংগ্রহের কাজ। সেই রস থেকেই খেজুরের গুড় পাটালি ও হাজারী তৈরি করা হবে।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা শিকদারপাড়া (গাছিপাড়া) এলাকায় হাজারী গুড়ের উৎপত্তি। যা দেশে ও দেশের বাইরে বেশ পরিচিত। উপজেলার ঝিটকা শিকদার পাড়া গ্রামে মো. হাজারী নামে একজন দক্ষ গাছি ছিলেন। যার দক্ষতা, সাধনা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আবিষ্কার করেন সুস্বাদু এই গুড়। তার নাম অনুসারেই এ গুড়ের নাম রাখা হয় হাজারী গুড়। কিন্তু বর্তমানে গাছিরা হাজারী পরিবারের না হয়েও সিল ভাড়া নিয়ে তৈরি করছেন হাজারী গুড়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এখন যারা হাজারী গুড় বানাই তারা বেশিরভাগই হাজারী বংশের না। এছাড়াও হাজারী পরিবারের লোকজন এখন গাছ কাটা এবং গুড় বানানোর সাথে সম্পৃক্ত নেই। হাজারী গুড়ের চাহিদা থাকায় সেই পরিবার থেকেই উপজেলার গাছিদের কাছে তাদের নিজেদের বানানো সিল ভাড়া দেওয়া হয়। ভাড়া সিলের জন্য প্রতিবছর প্রত্যেক গাছি থেকে বাজারের চেয়ে অনেক কম দামে গুড় কিনে নেই হাজারী বংশের শামীম হাজারী ও তার ভাইয়েরা। বাকি অল্প কিছু গুড় গাছিরা বাইরে বিক্রি করতে পারে। বাইরে গাছিরা ১৮০০ টাকা কেজি বিক্রি করতে পারলেও শামিম হাজারী গাছিদের ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা দাম দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গাছি বলেন, এই উপজেলায় এখন ৩০ থেকে ৩৫ জন গাছি হাজারী গুড় বানায়। এরমধ্যে হাজারী বংশের দুই একজন গাছি থাকতে পারে। তাড়াছা অন্য গাছিরা হাজারী পরিবারের শামিম হাজারীর কাছ থেকে ছিল নিয়ে গুড় বানায়। এই সিলের জন্য শামিম হাজারী প্রতি গাছির কাছ থেকে কম দামে গুড় কিনে নেই। বাজারে যে গুড় ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয় সেই গুড় শামিম হাজারী আমাদের ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা কেজি দাম দেই। আমরা এতো কষ্ট করে সবকিছু করেও এই সিলের সিন্ডিকেটের কারণে লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
গাছিরা দুঃখ করে বলেন, কষ্ট করি আমরা, আর লাভের গুড় পিঁপড়া খায়। গুড় উৎপাদন ও বিক্রি প্রশাসনের নেতৃত্বে উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবিও জানান তারা। উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে গুড়ের দামও কমবে।
উপজেলার ঝিটকা সরদার পাড়া গ্রামের হোসেন আলী বলেন, আমাদের এলাকায় ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড় তৈরি হলেও তা আমরা খেতে পারি না। কারণ যে দাম এতো দাম দিয়ে ১ কেজি গুড় কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। ২ মণ ধান বেচলে ১ কেজি গুড় হয়। ভাত খাবো নাকি গুড় খাবো। দাম কমলে হয়তো আমাদের কপালে জুটতো।
এ বিষয়ে শামিম হাজারী বলেন, আমাদের বংশে মো. হাজারী নামের একজন ব্যক্তি ছিলেন যার নাম অনুসারেই এই গুড়ের নামকরণ করা হয়। আমি তার ৬ষ্ঠ জেনারেশন। প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ বছর আগের ঘটনা। রাণী এলিজাবেথও এই গুড় খেয়ে প্রশংসা করেছে।
তিনি আরোও বলেন, বর্তমানে ২৭ থেকে ৩০ জন গাছি এই হাজারী গুড় বানায়। আমাদের বংশেরও ৩ থেকে ৪ জনে এই গুড় বানায়। আমাদের পরিবার ছাড়াও যারা গুণগত মান ঠিক রেখে এই গুড় তৈরি করতে পারে তাদেরকে গুড় বানানোর সিল এবং অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, কালের বিবর্তনে আমাদের দেশের খেজুর গাছগুলো অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশি বেশি খেঁজুর গাছ রোপণ করে এর চাষ বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই খেজুরের গুড়ের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে এবং গাছিরাও লাভবান হবে। উপজেলা কৃষি অফিস এ বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মনোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, মানিকগঞ্জের ঐতিহ্য হাজারী গুড়। এই গুড় মানিজগঞ্জ জেলার একটি ব্র্যান্ড। কিন্তু কিছু অসাধু গাছিরা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে ভেজাল গুড় তৈরি করছে। যা সুস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবছরই ভেজাল রোধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ বছরও ভেজালরোধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
(ঢাকা টাইমস/০৯ডিসেম্বর/এসএ)

মন্তব্য করুন