ইট ভাটায় পুড়ছে কৃষকের স্বপ্ন, বৈধতা না থাকলেও নীরব প্রশাসন

সিরাজগঞ্জে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনবসতি এলাকায় গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। দীর্ঘদিন থেকে অবৈধভাবে ভাটাগুলো পরিচালিত হয়ে আসলেও কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন অজ্ঞাত কারণে নীরব ভূমিকা পালন করায় জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। ফসলি জমির প্রাণ পোড়ানো হচ্ছে ইট ভাটায়। নিয়মনীতি না মেনেই জনবসতি ও ফসলি জমিতে অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মাণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার ফলে প্রতি নিয়তই পুড়ছে কৃষকের স্বপ্ন,। এই সব কারণে ফসল উৎপাদনে রয়েছে ধস নামার আশঙ্কা। অবৈধভাবে এই সব ইট ভাটা চলতে থাকলে জন জীবন হুমকির মুখে পড়ে যাবে। এই সব অবৈধ ইট ভাটার কারণে এক দিকে যেমন পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাস্তা ঘাট ও গাছপালা নষ্ট হচ্ছে।
পুরো জেলা ঘুরে জানা গেছে, ইট ভাটার সংখ্যা সব চেয়ে বেশি রায়গঞ্জ উপজেলায়। এই দুই উপজেলায় অনেকেই সরকারী নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে জনবসতি গ্রামের মাঝে এবং দুই ও তিন ফসলি জমিতে অবৈধ ইটাভাটা নির্মান ছাড়াও ইটভাটা আইন লঙ্ঘন করে ফসলি জমির মাটি দিয়ে ইট তৈরি করছে। সাধারণ কৃষকদের নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে সংগ্রহ করছে আবাদি জমির উপুরি ভাগের (টপ সয়েল) মাটি। দালালদের খপ্পরে পরে কতিপয় জমির মালিক ইটভাটায় মাটি বিক্রি করছেন। আবার কেউবা মাটি বিক্রি করছেন বিপদে পড়ে।
রায়গঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, মাটি কাটার মহা উৎসব। দেখার যেন কেউ নেই। উপজেলার ধানগড়া ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে বলেন, জেলার মধ্যে সব চেয়ে বেশি ইট ভাটা আমাদের উপজেলায়।কয়েকটি ইটভাটার পরিপূর্ণ কাগজপত্র আছে। অথচ আইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধ ভাবে চলছে এই সব ইট ভাটা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ইটভাটায় ইট তৈরির জন্য মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে কৃষি জমি থেকে। দালালরা জমির মালিকদের মাটি কাটার জন্য ভুল বুঝিয়ে অনুমোদন ছাড়াই এসব মাটি কেটে নিয়ে ইটভাটায় সরবরাহ করছে। প্রতিটি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে আবাদি জমি ও জনবহুল এলাকায়। নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব ইটভাটার মালিকেরা একের পর এক ফসলি জমির প্রাণ ধ্বংস এবং গাছপালা কেটে পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আবাদি জমির টপ সয়েল কেটে ড্রাম ট্রাকসহ ট্রাক্টরে লোড করা হচ্ছে। কেন তারা মাটি বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে কয়েকজন মাটি বিক্রয়কারী বলেন,পাশের জমির মালিক গত বছর মাটি বিক্রি করায় আমাদের জমিতে সমস্যা তাই আমরাও জমির মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।ভাটা মালিকরা অনেক সময় চালাকি করে এক ফুটের কাছে দের ফুট বা তার ও বেশি কেটে নিচ্ছে। ফলে তাদের সমস্যা থেকেই যায়। এই মাটি খেকোদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না দিলে এমন সমস্যা থেকেই যাবে বছরের পর বছর। এই সমস্যার কারণে মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতা,মালিক হারাচ্ছে তার স্বপ্ন আর পরিবেশ হারাচ্ছে তার পরম বন্ধু বিভিন্ন ধরনের গাছপালা। মাঝখান থেকে লাভবান হচ্ছে মাটি খেকোরা।
অপরদিকে জেলা ইট ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা তালুকদারের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাকে ফোনে পাওয়া যায় নি।
জেলায় মোট কয়টি ভাটার লাইসেন্স আছে এই বিষয়ে কথা হয় সিরাজগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তুহিন আলমের সাথে। মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন,জেলায় মোট ১৩১টি ইট ভাটা রয়েছে। তার মধ্যে ছাড়পত্র রয়েছে ৬৩ আর ছাড়পত্র নেই ৬৮টি ইট ভাটার। ছাড়পত্র ছাড়া বাকি ৬৮ ইট ভাটা কিভাবে চলছে এমন প্রশ্নের উত্তরে সহকারী পরিচালক তুহিন আলম বলেন,আমাদের অভিযান চলমান,বিগত দুই তিন বছর হলো প্রশাসনের সহযোগিতায় বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ বিভিন্ন সময়ে বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই বছরে যদি ছাড়পত্র বিহীন কোন ইটভাটা চলে তবে তার বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ামাদের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। কোন ইট ভাটার নামে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এদিকে সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩এর মাটির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসকরণে ৫এর ১ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষি জমির মাটি,পাহাড় বা টিলার মাটি কেটে সংগ্রহ করে তবে তা ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে় না। অথচ এই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জমির মাটি ও পুকুর কেটে সেই মাটি দিয়ে পস্তুত করা হচ্ছে ইট যা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ।এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। এভাবেই চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এই দেশে প্রচলিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে এমনটাই মনে করছেন সমাজের সচেতন নাগরিকগণ।
সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আ. জা. মু. আহসান শহীদ সরকারের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, প্রথমবার আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে দুই জনকে কারাগারে পাঠিয়েছি এবং মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করেছি। আমাদের অভিযান চলমান। কৃষি জমির টপ সয়েল বিক্রিসহ পুকুর খনন করে যারাই মাটি বিক্রি করবে এবং যারা কিনবে উভয়ের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই বিষয়ে প্রত্যেক উপজেলা কৃষি অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ পাওয়া মাত্র তারা উভয়ের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, প্রত্যেক উপজেলা পরিষদের প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। ছাড়পত্র ছাড়া কোন ইট ভাটা এবার চল্লে তাদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাদের হাইকোর্টে রিট রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। যারা এই রিটের বাইরে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্হা গ্রহণ করা হবে। ফসলি জমির মাটি, পুকুর খননের মাটি,পাহাড় বা টিলার মাটি কেটে তা সংগ্রহ করে তা ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করছে প্রত্যেক ইটভাটায় যা আইন গত অবৈধ এমন প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
(ঢাকা টাইমস/০৯জানুয়ানি/কেএ)

মন্তব্য করুন