যেসব লক্ষণে বুঝবেন প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত, বাঁচার উপায়

শরীরের যে কোনও অঙ্গে সামান্য সংক্রমণই পরবর্তীকালে বদলে যেতে পারে মারণরোগে। অনেক সময় দেখা যায় একজন ব্যক্তি হয়তো সুস্থভাবে জীবন যাপন করছেন। হঠাৎ করেই দেখা গেল যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা গেল তার ক্যানসার হয়েছে। এর মধ্যে তার কিছু লক্ষণও হয়তো শরীরে দেখা দিয়েছিল কিন্তু সেগুলো তিনি বুঝতে পারেন নি, অথবা গুরুত্ব দেননি। বিলম্ব করার কারণে ক্যানসার ইতোমধ্যে তার শরীরে অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। তখন চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সারিয়ে তোলা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।
ক্যানসার রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে ওঠার চাবিকাঠি এখনও অধরা। তাই ক্যানসারের আতঙ্কও সহজেই জাঁকিয়ে বসে। ক্যানসার কোনও নির্দিষ্ট কারণে হয় না। চিকিৎসকদের ভাষায় এটি একটি ‘মাল্টি ফ্যাকেটেরিয়াল ডিজিজ’। মূলত তেল-মশলাদার খাবার, অতিরিক্ত বাইরের খাবার, অতিরিক্ত চিনি ও ময়দা খেলে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। শরীরের কোনও কোষের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধিই ক্যানসারের অন্যতম কারণ।
ফুসফুস ক্যানসারের পরেই পুরুষরা সবচেয়ে বেশি যে ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তা হলো প্রস্টেট ক্যানসার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। এমনিতে এই ক্যানসার প্রাথমিক স্তরে ধরা পড়লে ভয় থাকে না।
তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণগুলো চিনতে পারা যায় না। তাই যখন সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং রোগ নির্ণয় করা হয়, তখন রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
চিকিৎসকদের মতে, বয়স ৫০ পেলোলে এই অসুখের আশঙ্কা বাড়ে। ‘পিএসএ টেস্ট’ বা ‘প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন টেস্ট’ করে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। সাধারণত রক্তে ‘পিএসএ’র মাত্রা ১ থেকে ৪-এর মধ্যেই থাকে।
অনেক সময় পরীক্ষা করে দেখা যায়, কারও কারও রক্তে ‘পিএসএ’র মাত্রা ৪-এর বেশি রয়েছে। এই মাত্রা ৪ ছাড়ালেই অসুখ বাসা বেঁধেছে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং নিশ্চিত হতে ‘ডিজিটাল রেক্টাল টেস্ট’ করাতে হয়।
তাতে যদি কোনো রকম স্ফীতি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে বায়োপসি করানো হয়। সময় মতো চিহ্নিত করা গেলে ৯৬ শতাংশর ক্ষেত্রেই বাঁচানো যায় রোগীর প্রাণ। তাই এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা আবশ্যক।
চলুন তবে জেনে আসি কী কী লক্ষণ দেখলে বুঝবেন আপনি প্রোস্টেট ক্যানসারে ভুগছেন-
প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে সমস্যা
প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা কিংবা প্রস্রাব পেলে ঠিক ভাবে মূত্রত্যাগ করতে না পারা এই রোগের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ। পাশাপাশি, এই রোগে বড় হয়ে যেতে পারে মূত্রস্থলীর প্রস্টেট গ্রন্থির আয়তনও।
বার বার মূত্র ত্যাগের প্রবণতা
বার বার প্রস্রাব পাওয়া প্রস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। বিশেষত, রাতের দিকে বার বার মূত্রত্যাগের প্রবণতা দেখা যায় আক্রান্তের। প্রস্রাব ত্যাগের প্রবণতায় যে কোনো রকম পরিবর্তন এলেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
মূত্রত্যাগের সময়ে ব্যথা
মূত্রত্যাগের সময়ে ব্যথা হওয়া মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। মূত্রত্যাগের সময়ে ব্যথা বা জ্বালা হওয়া একাধিক রোগের লক্ষণ হতে পারে। প্রোস্টেট ক্যানসারও তার ব্যতিক্রম নয়।
মূত্রত্যাগের সময়ে রক্তপাত
মূত্রের সঙ্গে রক্তপাত হওয়াকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘হিমাচুরিয়া’। মূত্রের সঙ্গে রক্তপাত হলে বা মূত্রের রং লাল, গোলাপী কিংবা গাঢ় বাদামী হয়ে গেলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
পিঠ ও কোমরে যন্ত্রণা
কোমরের নীচের দিকে একাধিক কারণে ব্যথা হতে পারে। তাই এই সমস্যা অবজ্ঞা করার প্রবণতা বিরল নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পিঠের নীচের দিক, কোমর, নিতম্ব, কুচকি ও থাইয়ের ব্যথা প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। বিশেষত, বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই উপসর্গটি অনেক বেশি দেখা যায়।
প্রোস্টেট ক্যানসার মূত্রাশয়ের নীচের অংশ এবং মলদ্বারের সামনের অংশটিকে বোঝায় এবং এই অঞ্চলটি ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রোস্টেট ক্যানসার প্রোস্টেট গ্রন্থিকে প্রভাবিত করে - এমন একটি কাঠামো যা শুক্রাণুর সাথে মিশে শুক্রাণু মিশ্রিত করে এমন তরল তৈরির জন্য দায়ী। ক্যানসারটি পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ, তবে এটির প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে চিকিত্সা করা সম্ভব। নিয়মিত পরীক্ষা, বিশেষত ৫০ বছরের বেশি বয়সী আপনার জন্য, ক্যানসার ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই পর্যাপ্ত পর্যায়ে এই ধরনের ক্যানসার সনাক্ত করতে সক্ষম হওয়া জরুরী।
প্রোস্টেট পুরুষ মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা বীর্য উৎপন্ন করে থাকে। এছাড়াও প্রোস্টেট গ্রন্থি যৌন হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে থাকে যা একজন পুরুষের স্বাভাবিক যৌন জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রস্টেট গ্রন্থির অবস্থান তলপেটে মূত্রথলির ঠিক নিচে (মূত্রথলীর গলায়) যা মূত্রনালীকে ঘিরে থাকে। আর তাই প্রোস্টেট ক্যানসার অনেক সময়ই মূত্রথলির ক্যানসার হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকে যদিও মূত্রথলী এবং প্রোস্টেট শরীরের দুটি ভিন্ন অংশ।
ক্যানসার হলো মূলত অস্বাভাবিকভাবে কোষ কলার বৃদ্ধি পাওয়া যার প্রভাব একসময় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রোস্টেট ক্যানসার বলতে প্রোস্টেট গ্রন্থির অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। তবে প্রোস্টেট গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দুই রকমের হতে পারে। যেমন:
ক্ষতিকারক নয় এমন বেড়ে যাওয়া যাকে মেডিকেলের ভাষায় বেনিজাইন বলা হয়। এই ধরনের প্রোস্টেট বৃদ্ধিকে বেনিজাইন প্রোস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া বলা হয়ে থাকে যা মূলত ক্যানসার নয়।
ক্ষতিকারক বৃদ্ধি যাকে মেডিকেলের ভাষায় মেলিগন্যান্ট গ্রোথ বলা হয় যা একসময়ে রক্ত ও লসিকা তন্ত্রের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এমনকি তা একসময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রোস্টেট ক্যানসারের সুস্পষ্ট কারণ জানতে সক্ষম হন নি। তবে কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যা রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত। যেমন:
পুরুষের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশেষত ৫০ বছরের পর থেকে প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। সাধারণত ৪৫ বছরের কম বয়সী পুরুষের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় না তবে ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যেতে পারে।
কালো বর্ণের মানুষদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।
কারো বংশে অথবা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে তাদের ক্ষেত্রে অধিক সম্ভাবনা রয়েছে।
যাদের যৌন রোগ রয়েছে যেমন সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদি।
যে সব পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে শল্যচিকিৎসা গ্রহণ করেন তাদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে।
অতিরিক্ত পরিমাণে লাল মাংস, চর্বি জাতীয় খাবার, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত ওজন, ধুমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস ইত্যাদি।
সাধারণত যাদের শরীরে প্রোস্টেট গ্রন্থি নেই তাদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। যেমন: মহিলাদের শরীরে কোন প্রোস্টেট গ্রন্থি নেই। তবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ক্ষেত্রে অনেকেই পুংলিঙ্গ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে থাকে। অর্থাৎ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অথচ যাদের শরীরে প্রোস্টেট গ্রন্থি রয়েছে তাদের বেলায় প্রস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রাথমিক অবস্থায় তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। কিন্তু ক্যানসার চিকিৎসায় সফলতা পাওয়ার জন্য প্রথম অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি। আর তাই এই ব্যাপারে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির নির্দেশনা হলো ৫০ বছরের পর থেকে প্রত্যেক পুরুষের জন্য নিয়মিত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো উচিত।
প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধের উপায়
প্রোস্টেট ক্যানসার একটি জটিল ও ভয়াবহ ব্যাধি। এর চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও রয়েছে নানাবিধ জটিলতা আর তাই সবচেয়ে সহজ ও সঠিক সিদ্ধান্ত হলো প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে সচেষ্ট হওয়া। কিভাবে প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়? কিছু সহজ ও কার্যকরী উপায় রয়েছে যা প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন:
গবেষণায় দেখা গেছে যে ধুমপান প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর তাই ধুমপানের অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে
কিছু কিছু খাবার রয়েছে যা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় এমন খাবারগুলো কম পরিমাণে খাওয়া উচিত।
যেমন: লাল মাংস, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি
তেমনি কিছু কিছু খাবার রয়েছে যা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
যেমন: মাছ, টমেটো, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি বেশি বেশি পরিমাণে খেতে হবে
ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে যা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। আর তাই প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম করা উচিত
একাধিক এবং অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্কের ফলে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
চিকিৎকদের মতে, নিয়মিত যৌন ক্রিয়া তথা বীর্যপাতের ফলে শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং শরীর থেকে শুক্রাণু ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান বেড়িয়ে যায় যা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। উল্লেখ্য যে সমস্ত পুরুষ মানুষ মাসে ৪ থেকে ৭ বার বীর্যপাত করেন তাদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসারের অধিক ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়াও হস্তমৈথুনের মাধ্যমে বীর্যপাতের বিষয়টিকেও নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। কারণ কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত পরিমাণে হস্তমৈথুন করার ফলে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আর তাই পরিণত বয়সে বিয়ে করে নেওয়া উচিত।
প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসক রোগীর কাছ থেকে সমস্ত রোগ লক্ষণাবলী ও বংশ ইতিহাস সংগ্রহ করেন। অতঃপর শারীরিক পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। ডাক্তার প্রোস্টেট ক্যানসারের ক্ষেত্রে পায়ুপথে গ্লভস পড়া আঙ্গুল প্রবেশের মাধ্যমে প্রোস্টেটের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করেন।
ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও কার্যকরী পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে বায়োপসি অন্যতম। প্রোস্টেট ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট গ্রন্থি থেকে কোষকলা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসার সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। আর এই পদ্ধতিকেই মেডিকেলের ভাষায় বায়োপসি বলা হয়ে থাকে।
(ঢাকাটাইমস/১৯ মে/আরজেড)

মন্তব্য করুন