নবান্ন উৎসবে জমজমাট মাছের মেলায় জামাইদের প্রতিযোগিতা
অগ্রহায়ণ মাস শুরু হতেই গ্রামবাংলায় ফসল তোলার ধুম পড়ে যায়। নতুন ধান ঘরে তোলেন কৃষকরা। শুরু হয় নবান্ন। কৃষিমুখী মানুষগুলোর মাঝে বইতে থাকে উৎসবের হাওয়া। যান্ত্রিক সময়ে এসব খুব একটা দেখা যায় না। তবু এখনো বহু গ্রামে টিকে আছে নবান্নের রীতি।
এমনই ধারাবাহিকতার দেখা মিলে জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের পাঁচশিরা বাজারে। নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে সেখানে বসেছে মাছের মেলা। কাতলা, রুই, মৃগেল, চিতল, গ্রাসকার্প, কার্ফু, কালবাউশ, ব্রিগেড, সিলভার কার্পসহ হরেক রকমের মাছের পসরা।
ভোর থেকে বসে যায় সারি সারি মাছের দোকান। চলছে হাঁকডাক ও দরদাম। ৫ কেজি থেকে শুরু করে ১৮ কেজি ওজনের বড় মাছ। মাছের আকার অনুযায়ী প্রতি কেজি মাছ ৩০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা গেল, প্রতি বছরের মতো এবারও রবিবার কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে বসেছে মাছের মেলা। নবান্ন উৎসবে প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের ২ তারিখে এখানে মাছের মেলা বসে। মেলায় অংশ নেন উপজেলার মাত্রাই, বিয়ালা, সোমশিরা, শালগুন, গাড়ইল, দুধাইল, কাশিপুর, হাতিয়র, মাদারপুর, জিন্দারপুর, হারুঞ্জা, পুনট, বেগুনগ্রাম, পাঁচগ্রামসহ আশপাশের ৭০-৮০টি গ্রামের মানুষ।
উৎসবে প্রতি বাড়িতে মেয়ে জামাইসহ স্বজনদের আগে থেকে নিমন্ত্রণ করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন আসেন মেলায় মাছ কিনতে। এই মাছের মেলায় ক্রেতারা দারুণ উৎসাহের সঙ্গে হরেক রকমের মাছ। আবার এসব মাছ দেখতে এসেছেন অনেকেই।
তবে এই মাছের মেলায় শুধুই মাছ কেনার বিষয় নয়, আছে একধরনের জামাই-মেয়েদের কেনার প্রতিযোগিতা। কোন জামাই কত বড় মাছ কিনলেন, সেটাই আসল বিষয়। প্রতিযোগিতায় নীরব অংশগ্রহণ করে শ্বশুরেরা।
মাসে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে চলে আসছে এই মাছের মেলা। এ উৎসবকে ঘিরে এখানে দিনব্যাপী চলে মাছ কেনা ও বিক্রির উৎসব। ক্রেতারা মাছের দাম হাঁকেন, কেনেন, আবার কেউ কেউ সেলফি তুলতেও ব্যস্ত। শুধু সেলফি তুলেই শেষ নয়। মাছ মেলার ছবি দিয়ে কেউ কেউ আবার ঝড় তুলছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও।
মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যের পসরা বসে এই মেলায়। ক্রেতারা খালি হাতে ফিরছেন না কেউ। সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী মাছ কিনে খুশিমনে বাড়ি ফিরছেন। মেলা উপলক্ষে আশপাশের গ্রাম-মহল্লায় বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। নাইওর এসেছেন মেয়ে ও জামাই। এ যেন এলাকায় ঈদের আনন্দ।
এই দিনটির জন্য পুরো বছর অপেক্ষায় থাকেন কালাই উপজেলাবাসী। মেলায় ঘুরতে আসা মোছা. রোমানা আক্তার বলেন, ‘আমার বিয়ের পর থেকেই আমি প্রতিবছর এই মেলা দেখতে আসি। এ মেলার জন্য আমরা আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করি। আমাদের বাড়ির জন্য এবার ১২ কেজি ওজনের কাতলা মাছ কিনেছি।’
উপজেলার মাত্রাই গ্রামের বাসিন্দা মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘এই নবান্নের মেলা আমাদের কাছে ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের। বাড়িতে মেয়ে জামাই, ভাগ্নি জামাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। মাছের মেলা কেন্দ্র করে তারা বাড়িতে এসেছে।’
মেলায় মাছ কিনতে আসা চঞ্চল বাবু নামে এক জামাই বলেন, অন্য বছরের চাইতে এবার মাছের দাম একটু বেশি। তবে যাই হোক না কেন এই মেলা থেকে ১৮ কেজি ওজনের একটি গ্রাসকার্প মাছ কিনে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি।’
পাশের টাকাহুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুল মতিন সরকার জানান, ঐতিহ্যবাহী মেলাটি যেমন মাছের জন্য বিখ্যাত, তেমনি এই এলাকায় ধান-আলুতেও ভরপুর থাকে। এ কারণে আশপাশের লোকজন মেলায় ছুটে আসে।
এই মেলায় মাছ বিক্রেতা আব্দুল লতিফ বলেন, মেলার জন্য বড় পুকুর, দিঘি ও নদী থেকে নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাতলা, রুই, মৃগেল ব্রিগেড, সিলভার ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
কালাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তৌহিদা মোহতামিম বলেন, প্রতি বছর এই মেলাকে ঘিরে এলাকায় উৎসব বিরাজ করে। আজও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ মেলায় এবার দিন শেষে অন্তত কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হবে। মেলায় কেউ যেন বিষযুক্ত মাছ বিক্রি করতে না পারে সেদিকে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি রয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/১৭নভেম্বর/মোআ
মন্তব্য করুন