বইঃ আমার কথা
একটি দেশের জন্ম : অপরাধবোধ ও স্বীকারোক্তি
সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘আমার কথা’। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকাণ্ড, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন। এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ‘ঢাকাটাইমস২৪ডটকম’ ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। বইটির আজকের শেষ পর্বে থাকছে - ' একটি দেশের জন্ম : অপরাধবোধ ও স্বীকারোক্তি ’
বস্তুত আমাদের স্বাধীনতা লাভের আকাক্সক্ষা, স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রস্তুতি অনেক আগের। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন পরিণতি লাভ করে। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন- এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম প্রস্তুতি। চুয়ান্ন’তে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে আমাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়- এটা হলো স্বাধীনতা লাভের দ্বিতীয় ধাপ। তৃতীয় ধাপে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন। এক্ষেত্রে সামরিক শাসন ও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে ‘না’ বলার সাহস প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্থ ধাপে ছেষট্টি’র ছয়-দফার মোড়কে স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। পঞ্চমত আটষট্টির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলনে জনগণের ঐক্যমতের প্রতিফলন প্রদর্শন যা উনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ষষ্টত সত্তরের নির্বাচন যার মাধ্যমে বাঙালির নেতৃত্ব চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। প্রস্তুতির প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি আন্দোলনে, বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাঙালির, বাংলাদেশের হারানো স্বাধীনতা অর্জিত হয়। তাই তিনি বাংলাদেশের জাতিরজনক। জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রস্তুতিপর্বে আদর্শ নিয়ে, লক্ষ্য নিয়ে, নেতৃত্ব নিয়ে- পক্ষ ও বিপক্ষের উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা, মহান মুক্তিযুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষের সরল উপস্থিতিও আমরা লক্ষ্য করেছি। এ পক্ষ-বিপক্ষের উপস্থিতি দেখেছি- দেশের অভ্যন্তরে, দেখেছি- আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। শেষাবধি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা, স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে- বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ জয় লাভ করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অভ্যন্তরীণভাবে, দেশের ভিতরে যারা স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে, যারা রাজাকার, আলশামস, আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছে, দেশের স্বাধীনতাকে যারা বিলম্বিত করেছে, বাইরের শক্তিকে সহযোগিতা করেছে, অসংখ্য প্রাণহানি ও ধ্বংসে যারা মদদ দিয়েছে- সেই স্বাধীনতা বিরোধীরা আজও তাদের অপরাধকে স্বীকার করেনি। তাদের ভুল স্বীকার করেনি। তাদের অপরাধের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাননি। তাদের এ অপরাধের কারণে, স্বাধীনতা বিরোধী অপরাধের কারণে, মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পার করলেও আমরা জাতিকে কলংকমুক্ত করতে পারেনি। শহীদদের আত্মার প্রতি আমরা ন্যায়-বিচার কায়েম করতে পারিনি। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন এবং ইতোমধ্যে শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও ফাসির রায় কার্যকর করেছেন। বাংলাদেশকে কলংকমুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন।
এ প্রসঙ্গে আমাদের কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ-এর ‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’ একটি ছবির গল্প মনে পড়ছে। ছবিটি আমি এবং আমার সহধর্মিণী খাজা নারগীছ হোসেন নিবিষ্ট চিত্তে দেখেছি। ছবির গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সামাজিক সমস্যা নিয়ে একটি পারিবারিক ছবি। সামাজিক সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠার একটি গল্প। সামাজিক কুসংস্কার, শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রতুলতা, শিশু স্বাস্থ্য ইত্যাদি সামাজিক বিষয়গুলো এ গল্পে উঠে এসেছে।
গ্রামের জমিদার। যিনি মধ্যযুগীয় কায়দায় গ্রামে রাজত্ব করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জমিদার পাক-বাহিনীকে তার বাড়ীতে আস্তানা গড়ে তুলতে অনুমতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ বাহিনী স্থানীয় জনগণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করে। স্বাধীনতা লাভের পর জমিদারের একমাত্র ছেলের সাথে মুক্তিযুদ্ধে তার বাবার অবস্থান নিয়ে বিরোধীতা দেখা দেয় এবং এক পর্যায়ে ছেলে বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে শহরে চলে যায়। চব্বিশ বছর পর ছেলের দুই মেয়ে দাদুর বাড়িতে বেড়াতে আসে, শেঁকড়ের সন্ধানে। কিছুদিন তারা দাদুর সাথে বসবাস করে। দু’নাতনির একজন সদ্য পাশ করা ডাক্তার। ভাল আচরণ, সেবামূলক মনোভাবের জন্য ডাক্তার নাতনী এলাকার জনগণের ভালবাসা অর্জন করে। এবং এলাকায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে। একদিন এক প্রসূতি নারীকে, তার সন্তানকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলেন। প্রসঙ্গত নাতির এ অবদান দাদা জমিদারকে অতীত স্মৃতিতে নিয়ে যায়। জমিদার স্ত্রী প্রসুতি ব্যথায় আক্রান্ত হলে তৎকালীন শহুরে ডাক্তার বলেছিলেন- হয় মাকে বাঁচানো যাবে- নতুবা সন্তানকে। জমিদার সন্তানকে, যিনি তার একমাত্র ছেলে, বাঁচানোর সম্মতি দিয়েছিলেন। প্রেক্ষিতে তিনি মৃত্যুর পর স্ত্রীর মুখদর্শন করতে সাহস পাননি। নাতনীকে বললেন- তখন যদি তোর মত ডাক্তার থাকতো- তাহলে হয়তো তোর দাদিকে অকালে হারাতে হতো না। ডাক্তার নাতনীর আচরণে, দাদা খুব খুশি হোন। খুশি হয়ে নাতনীকে তার কাছে কিছু চাইতে বলেন। কাহিনীর শেষাংশে নাতনী দাদার কাছে তিনটি দাবী উত্থাপন করেন- ১. তোমাকে সব সম্পত্তি এখানে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় দান করতে হবে। ২. তোমাকে এরপর থেকে আমাদের সাথে শহরে গিয়ে থাকতে হবে। ৩. তোমার যুদ্ধকালীন ভুলের জন্য, অপরাধের জন্য জনগণের কাছে, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু জমিদার দাদা এতে সম্মতি না দিলে ডাক্তার নাতনী পরের দিন এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
পরের দিন দু’বোন ঘর থেকে বের হলেন। রাস্তায় নেমে দেখেন- স্থানীয় জনগণ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তাদের সম্বর্ধনা জানাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন- ‘আপনি আমাদের জন্য এতো কিছু করেছেন- এটা তো সামান্য আয়োজন। ইতোমধ্যে জমিদার দাদার সেখানে আগমন ঘটে। তিনি গ্রামবাসীর সামনে ঘোষণা দিলেন- আজ থেকে আমার ডাক্তার নাতনীর অভিপ্রায় অনুযায়ী- আমার এই জমিদার বাড়িতে একটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য আমার সব সম্পত্তি দান করলাম। আর অতীতে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমি না বুঝে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে পাক-হানাদারকে সহায়তা করেছিলাম- তারা যে এতো অত্যাচার করবে- তা আমি বুঝিনি। যাহোক, আমার অজানা অপরাধের জন্য আমি মহান আল্লাহর কাছে, আপনাদের কাছে, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। এভাবে জমিদার তাঁর সব সম্পত্তি হাসপাতালে দান করেন, জনগণের ক্ষমা চান- এভাবে ছবি শেষ হয়।
হুমায়ুন আহমেদের এ ছবি শেষাংশে জমিদারের যুদ্ধকালীন ভুলের স্বীকারোক্তি এবং মাফ চাওয়া দেখে আমার মনে হয়েছে- স্বাধীনতার সময় যারা মুষ্টিমেয় লোক, স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছে, পাক সেনাদের সহযোগিতা করেছে, কোলাবোরেটর হিসেবে সহযোগী হয়েছে- তারা যদি সে সময় তাদের সম্পত্তি রাষ্ট্রকে দান করে, তার অন্যায়ের জন্য দেশবাসীর কাছে ভুল স্বীকার করতো, ক্ষমা চাইতো- তাহলে স্বাধীনতার কয়েক যুগ পর তাদেরকে রাষ্ট্রের এভাবে বিচার করতে হতো না। যারা অন্যায়-অপরাধ করেছেন- শুধুমাত্র তাদের বিচার করা হলে- আজ জাতিকে দায়বোধে অভিযুক্ত হতে হতো না। সবাই মিলে বাংলাদেশের উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা যেত। আজ আমার নেত্রী শেখ হাসিনাকে উজানে নৌকা বাইতে হতো না। তাঁকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও উন্নয়ন কাজ একত্রে এগিয়ে নিতে হতো না। তিনি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কাজে মনোনিবেশ করতে পারতেন। ঘরে-বাইরের শত্রুতা, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নেয়া যে কত কঠিন তা সহজবোধ্য। তবুও মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে দেশ পরিচালনা করছেন- তা ইতিহাসে মাইফলফলক হয়ে থাকবে। আজ জাতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্যবদ্ধতা আমাদের শক্তি। এ ঐক্যবদ্ধতাই আমাদের উন্নয়ন, আমাদের অগ্রগতি। আরও পড়ুন - সত্য ও ন্যায় : সমাজ ও জীবনের প্রত্যয়, সত্য ও ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লায় আমি নির্দোষ, আমি, পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাঃ একটি পর্যালোচনা, সুস্থ মানুষ ও সুস্থ নেতা, একটি শিশুর স্বপ্ন, 'মন্ত্রিসভার রদবদল’ পর্যটন ও ভ্রমন, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ, জাতিগত ঐক্য : অপরিমেয় শক্তির আধার, প্রেরণা ও উৎসাহঃ কর্মক্ষমতা বাড়ায়, ‘কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে প্রত্যাশা’ বৈশ্বিক সহায়তা, বাংলাদেশের সফলতা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের গুরুত্ব, সরকারি কাজের পর্যবেক্ষণ, ব্যবসায়ীদের বিশ্বসমাবেশ, ‘‘অসম্ভব’: একটি ভৌতিক শব্দ’ 'বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া', ‘ক্যারিয়ার গঠনে প্রতিযোগিতা’ ঝুঁকি বনাম সাফল্য, ভিশন-২০২১, ‘সৃজনশীলতা’ ‘বিনিয়োগ’, ‘বাংলার বসন্ত’, ‘সময়, শ্রম ও অধ্যবসায়’ ‘আমার আদর্শ আমার নায়ক’ , ‘ধৈর্য পরীক্ষা’, ‘খেলাধুলা ও বাংলাদেশ’ ‘অধ্যয়ন, লেখালেখি ও নেতৃত্ব’ ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ’, ‘সাফল্যের স্বর্ণদ্বার’ , ‘ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাফল্যের মেরুদণ্ড’ ‘পদ্মা সেতু’, `বিজয়চিহ্ন 'V' প্রকাশে ভিন্নতা', ‘উন্নয়ন ও অগ্রাধিকার’ , ‘ইতিবাচক ভাবনা সাফল্যের চাবিকাঠি’ , ‘ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে’ ‘মাতৃভাষার প্রতি মমতা’, ‘সুখ ও শান্তি : আমাদের করণীয়’ , ‘নেতৃত্বের শক্তি’, ‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’, ‘আমার প্রাত্যহিক জীবন’, 'আমার অনুভব'।
মন্তব্য করুন