সময় এখন ‘জয় বাংলা’র, তবে লক্ষণ ভালো নয়...

আমার জন্ম হয়েছে পঁচাত্তরের মর্মান্তিক পট পরিবর্তনের পর। আমার আব্বা তখন দেশের জন্য নিবেদিত এক যুদ্ধজয়ী রাজনৈতিক কর্মী। মুজিবকে হৃদয়ে ধারন করে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবে এই ভাবনায় যোগ দিয়েছিলেন “মুজিব বাহিনী” তে। গোটা বাংলায় এখনো এই মুজিব বাহিনী এক অঘোষিত নিষিদ্ধ নাম। তাদের অপরাধ? তারা মুজিবকে ভালবাসতেন, তাকে অনুভব করতেন। মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে শহীদ ফজলুল হক মনি’র নেতৃত্বে (১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এ শহীদ, জাতির পিতার ভাগ্নে ও আওয়ামী যুবলীগ এর প্রতিষ্ঠাতা), তৎকালীন তুখোর তোফায়েল আহমেদ (বর্তমান মন্ত্রী), প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক (সাবেক মন্ত্রী) সার্বিক পরিচালনায় আরো ছিলেন সিরাজুল আলম খান, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে রহস্য পুরুষ বা দাদাভাই নামেই খ্যাত।
তিন দিন বা ঘণ্টা নয় অত্যন্ত কঠোর ও কঠিন এক অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে আব্বা ভারতের সুবিখ্যাত ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি, দেরাদুন থেকে দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে কমান্ডার হয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধ করেছেন কিশোরগঞ্জের ভাটি এলাকায়। এটা নিশ্চয়ই সবাই জানেন আমাদের কিশোরগঞ্জ স্বাধীন হয়েছে একদিন পর আর সর্বশেষ যুদ্ধ বাইল্লাবাড়িতেও তিনি ছিলেন। যে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন আমাদের নিকলীর ষাইটদ্বারের জনাব শাহাবুদ্দিন। কিশোরগঞ্জের বাইল্লাবাড়িতেই হওয়া উচিৎ আমাদের কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ। আরো বিস্তারিত বলবো খুব শীঘ্রই...
মুজিব হত্যার প্রথম প্রতিবাদ হয়েছিলো আমার আব্বাসহ আরো কয়েকজন সাহসী তরুণ যুবার নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জের আখড়া বাজার মোড় থেকে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় আব্বাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো প্রথম দিকেই। তিনি ছিলেন রাজবন্দী। ময়মনসিংহ জেলে প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ আরো অনেকেই ছিলেন অনেকদিন একসাথে। যখন মুক্তি পেলেন তখন আওয়ামী লীগ করবে এমন লোক কোথায়? চেনা মানুষেরাও ভীষণ অচেনা, পারলে এড়িয়ে যেতো সবাই। “জয় বাংলা” তখন নিষিদ্ধ শব্দ এক...
ইতিমধ্যে উর্দি পড়েই রাজনৈতিক দল খুলে বসেন এক সমরনেতা। অতি ডান, বিষণ্ণ বাম, বিপর্যস্ত পাকিস্তানী দোসর, কতিপয় বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধা আর ক্ষমতার হালুয়া রুটির কাঙ্গাল কিছু আমলা মিলে গড়ে তোলার পাঁয়তারা করে একটি গোঁজামিলের বাংলাদেশ। এই দেশে মুজিব নিষিদ্ধ, কিছুটা খলনায়ক, ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের জিম্মায় চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিলো, সেখান থেকে জাতিকে মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে দেন সেই মহান ফৌজি অধিপতি!!!
পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে গণমাধ্যম কোথায় ছিলো না মুজিব কিংবা জয় বাংলা। এর মাঝে একদল বিপথগামী হত্যা করে সেই কথিত মহানায়ককে। তার স্থান দখল করে আরো এক উর্দিধারী, যিনি আবার পাকিস্তান ফেরত, তিনি চাইলেন “নতুন বাংলাদেশ” গড়তে। দশ বছরের চেষ্টায় বিফল হয়ে রনে ভঙ্গ দিয়ে এখনো জেলের ভয়ে তিনি কাবু, কিন্তু ক্ষমতায় যেতে তিনি এখনো “ফ্যাক্টর”। তবে রাজনীতির মাঠে তিনি এখন পাকা খেলোয়াড়দের কাছে বড্ড অসহায়।
যাই হোক, ১৯৯০ সালেও সবাই ভেবেছিলেন আসবে নৌকা, এলো না। কারণ ভোটের আগেই বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিলো, তাই স্বাধীনতার ২০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ফিরে আসে পাকিস্তানের প্রেতাত্না সমেত সেই গোঁজামিলের সরকার...
১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর হাজারো মুজিব ভক্তের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফিরে আসে জয় বাংলার সরকার। পোড় খাওয়া নেতাকর্মীদের যেখানে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কথা, সেখানে তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখা দেয় বসন্তের কোকিলদের বৃত্ত বলয় দেখে। অভিমানে সরে যায় ভালোবাসার মানুষেরা। দল তখন ক্ষমতার উত্তাপে ভীষণ উষ্ণ, শীতের ছেঁড়া কাঁথা তখন ভীষণ অপ্রাসঙ্গিক...
ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ও দলে প্রতিদ্বন্দ্বী রুখতে পথের কাঁটা দূর করার সেটাই ছিলো মোক্ষম সময়! আর তার ফলশ্রুতিতে ২০০১ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে করুনভাবে পরাজিত হয় জয় বাংলা। শুরু হয় নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণ। জোটের ভোট ও যূথবদ্ধ চলাফেরা শুরু। এই সুযোগে অতি বাম কিছু দলে ভীরে আর অতি মুজিব বিরোধীরা কাছে আসে। মুজিবপ্রেমীরা তখন কেউ কেউ দূরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর কেউ কেউ চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছে বুকের কষ্ট চেপে...
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেও শাহবাগ উত্তাল হয়েছিলো কেন? কারণ তরুণ প্রজন্ম তখনো জয় বাংলাকে ভালোবাসলেও জয় বাংলা’র কান্ডারিদের ভরসা করতে পারছিলেনা। কেন এই অবিশ্বাস? ভাবতে হবে এখনই, তা না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে...
দলের নাম ভাঙ্গিয়ে সরকারি সুযোগ যুবিধা নিচ্ছে কারা, খুঁজে বের করতে হবে এখনই, তা না হলে আকাশে শান্তির নিশান বিমানে কেন এই নাট-বল্টু নিয়ে তোলপাড়? আদালতের রায়ে স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার শিরোমণি গোলাম পুত্র আর একটু হলেও হয়ে যেতো দেশের সার্বভৌমত্বের প্রধান পাহারাদার। আর এই বিজয় দিবসে তো পিরোজপুরের ইন্দুরকানি (সাবেক জিয়ানগর) দেখিয়েই দিলো আমরা কতটা গণতান্ত্রিক, আর পাক পূজারি! স্বাধীনতা বিরোধীর হাতে উঠেছে জাতীয় পতাকা আর মুক্তিযোদ্ধারাও নিয়েছেন সম্মাননা তার হাত থেকেই, যার পিতা এখনো যুদ্ধের সময় করা মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে কারারুদ্ধ। সেই উপজেলা কি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাইরে? সেখানে কি যুদ্ধের সময় আদৌ কেউ নির্যাতিত হয়েছিলেন? সেখানে কেউ কি আছে, সত্যিই যিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন? সরকারের উচিৎ সেখানকার মানুষের উপর একটা জরিপ চালিয়ে এর কারন উদ্ঘাটন করা, কেন ও কিভাবে আমাদের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ ধরিয়ে সেই যুদ্ধাপরাধীর পুত্র বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলো... নাকি শর্ষের ভেতরেই ভূত?
ছোটবেলায় আমাদের গালি দেয়া হতো, “রুশ ভারতের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান” বলে। এখন তারা সদলবলে, সপরিবারে বা গোষ্টিশুদ্ধ জয় বাংলা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে আর গাঁয়ে নানা রঙ্গের ও ঢঙ্গের বিকৃত মুজিব কোট চাপিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়। আওয়ামী বা লীগযুক্ত ভুঁইফোঁড় সংগঠনের নানা পদ পদবি বাগিয়ে তাদের দাপটে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। পিতৃপুরুষের আবেগের জয় বাংলা কি তবে দেউলিয়া হয়ে গেলো? কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে ফুলের তোড়া দিলেই হলো, ইরেজার দিয়ে অতীত মুছে ফেলা যাবে? মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও স্বাধীনতা এনে দেয়া সংগঠনে কিভাবে ঠাঁই পায় মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধীতাকারী বা সেই দলের পান্ডারা? ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে...
এবারের বিজয় দিবসে গিয়েছিলাম কিশোরগঞ্জে, আব্বার অবর্তমানে আমাদের নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনায়, আয়োজক জেলা প্রশাসন, দিনটি ছিলো শুক্রবার। ভীষণ বিরক্ত হয়েছি আর কষ্ট পেয়েছি দায়সারা আয়োজন ও অব্যবস্থাপনা দেখে। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জনাব আসাদুল্লাহ আসাদ চাচা বলছিলেন, তিনি ছিলেন একটি ভাইভা বোর্ডে, সেখানে নিয়োগ দেয়া হচ্ছিলো মুক্তিযোদ্ধা কোটায় শিক্ষক। সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার স্বজন, সবাইকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিলো বাবার মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি জানা থাকলে বলতে, একটি মেয়ে সামান্য বলতে পারলেও বাকি কেউ কিছুই বলতে পারেননি। এই যদি হয় মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্ম, তাহলে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে, তারা আদৌ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান? তাদের পিতা কি সত্যিই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? আমার বাবার বীরত্বের গল্প আমি শুনবো না, জানবো না?
তাই আমার ভয় হয়, আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? রামু, নাসিরনগর, গাইবান্ধা ও বিমানের ষড়যন্ত্র হয়ে পাঠ্যপুস্তকে অদ্ভুত বিষয় বস্তুর আমদানির পরে আর কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য? গোটা দেশে এখন একটি মাত্র দল ও তার সমর্থক সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ মঙ্গলজনক নয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝেই সেরা নেতৃত্ব ও গ্রহণযোগ্য কর্মপন্থা বেরিয়ে আসে। এটা গণতন্ত্রের জন্যও জরুরি।
সময় এখন জয় বাংলার, নেতার চেয়ে নিজের ছবি বড় করে (আসলে বাঁশের চেয়ে কইঞ্চা বড়! এটা প্রমাণ করার জন্যই তারা মরিয়া) নানা পদের, নানা ডিজাইনের, কারণে অকারণে, নানা ছুতোয় ব্যানার, পোস্টার আর তোরণে গোটা দেশ এখন সয়লাব। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নির্বাচন, মনোনয়ন থেকে সভা সম্মেলন, সর্বত্রই শুধু জয় বাংলা, তার পরেও কেন যেন মনে হয় লক্ষণ ভালো নয়...
উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী
মোহাম্মদপুর, ঢাকা

মন্তব্য করুন