অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-২৯
সুগন্ধার টিমে সংগ্রহ ও প্রাপ্তির তালিকার মাসুদ কামাল, জহিরুল আলম, শহিদুল আজম, শওকত আলী সাগর ও মোস্তফা কামালের প্রসঙ্গ অতি সংক্ষেপে বলা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত একদমই বলা হয়নি আবদুস সালামের কথা। এর অর্থ এই নয়, সে সুগন্ধার ইতিহাসের বাইরের কেউ। বরং উল্টো। আবদুস সালাম সুগন্ধার ইতিহাসের খুবই উল্লেখযোগ্য চরিত্র। তার কারণে আমার নেতৃত্বে সুগন্ধা প্রকল্প ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়েছিলো। অবশ্য এর পেছনে সুগভীর ষড়যন্ত্র ছিলো, আর ব্যর্থতার দায় ছিলো আমারও।
আবদুস সালাম কিভাবে সুগন্ধায় সংযুক্ত হয়েছিলো তা আমার আজ স্মরণে নেই। সম্ভবত সে রবাহুত। প্রথম এসেছিলো বলেই প্রিন্টার্স লাইনে সহকারী সম্পাদক হিসেবে মাসুদ কামালের নামের ওপর তার নাম দিয়েছিলাম। এটি ছিলো ভুল সিদ্ধান্ত। এ ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যে। তার অবসাবধানতাপ্রসূত ভুলের কারণে মহাবিপদে পড়তে হয়েছিল গোটা টিমকে। এমনকি সুগন্ধা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। পত্রিকা মার্কেটে দেয়া ও জনবল সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমরা যখন অনেকটাই ফুরফুরা মেজাজে তখনই ঘটলো অঘটন। আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। কিন্তু শেষতক ষড়যন্ত্রকারীদের অতি খেলা আমাদের বাঁচিয়ে দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল জাফর ইমামের বিচক্ষণতা; সে সময়ে তিনি ছিলেন বন ও পরিবেশমন্ত্রী।
সুগন্ধায় জেলা-উপজেলা নামে দুই পৃষ্ঠা জুড়ে সংবাদদাতাদের রিপোর্ট ছাপা হতো। আমি বরাবরই ঢাকার বাইরের খবরকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সুগন্ধার এ বিভাগের দায়িত্বে ছিলো আবদুস সালাম। মফস্বল থেকে সপ্তাহে অন্তত পাঁচশ রিপোর্ট আসতো। এসব রিপোর্ট থেকে আট/দশটি বাছাই করা মোটেই সহজ কাজ ছিলো না। এ কঠিন কাজ করতে গিয়েই ভয়ানক ভুল করে বসলো সালাম। নোয়াখালীতে দুই তরুণীকে ধর্ষণ করে একটি পরিত্যক্ত মন্দিরে ফেলে যাবার খবর ছাপা হলো সুগন্ধায়। অগোছালো পরিস্থিতির কারণে ছাপার আগে এটি আমিসহ কারোই নজরে পড়েনি। তার প্রতি অতিরিক্ত আস্থাও ছিলো এ সর্বনাশের আর এক কারণ। কপালে দুর্ভোগ থাকলে যা হয় আরকি! পত্রিকা মার্কেটে যাবার কয়েক ঘণ্টা পরই ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি উদগিরণের মতো অবস্থা হলো। মহাবিপদের আলামত দেখলাম আমরা। সবাই চুপচাপ বসেছিলাম শবযাত্রা শুরুর আগের মূহুর্তের মতো। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় ছুটতে ছুটতে অফিসে এলেন মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হুসাইন। সোজা আমার টেবিলে গিয়ে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে; কর্নেল জাফর ইমাম স্যার ডেকেছে! এ সময় প্রায় থরথর করে কাঁপছিলেন তিনি। আমি তাকে বললাম, আপনি একটু শান্ত হন। তিনি কাঁদো কাঁদো ভাবে বললেন, “রাখেন সাহেব আপনার পাকনামি; আগে পত্রিকা বন্ধ করেন!” আমি বললাম, পত্রিকা বন্ধ করা যাবে, কোন অসুবিধা নেই; চলেন আগে মন্ত্রীর কাছে যাই।
লিফট বাদ দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তিন তলা থেকে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে নামলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম। নিজে দরজা খুলে প্রথমে আমাকে গাড়িতে উঠালেন। ভাবখানা এই, আমি যদি ভেগে যাই! গাড়িতে উঠে তিনি আবার বললেন, পত্রিকা বন্ধ করেছেন? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আপনি একটু থামেন তো; মন্ত্রীর সঙ্গে আগে কথা বলি, প্রয়োজন হলে টেলিফোনে পত্রিকা বন্ধের কথা জানিয়ে দেব; পত্রিকা বন্ধ করা কোন সমস্যা না। কর্মচারীর মৃদু ধমকে মালিক একদম চুপসে গেলেন।
আমরা অল্প সময়ের মধ্যে সচিবালয়ে পৌঁছে গেলাম। এতক্ষণ নীরব থাকলেও সৈয়দ মোয়াজ্জেম খুবই সরব হলেন মন্ত্রী কর্নেল জাফর ইমামের সামনে গিয়ে। তার অবস্থা কাঁদো কাঁদো। কিন্তু ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো ডায়লগ একটাই। বারবার বলতে লাগলেন, “স্যার আমি পত্রিকার কিছু জানি না; আগে চালাতো নোয়াখালীর খোন্দকার মোজাম্মেল, আর এখন চালায় বরিশালের এই আলম রায়হান, আমি কিছু জানি না!” বাওয়ালীকে বাঘের মুখে ঠেলে দেবার মতো কাজ করলেন তিনি। আমার চোখে চোখ রাখলেন কর্নেল জাফর ইমাম। তার চোখ লাল হয়ে ছিলো। চিলের ডাকের মতো তিক্ষ কণ্ঠে সংক্ষেপে বললেন, “কী বলবেন, বলেন!” আমি যতটা সম্ভব আতঙ্ক চেপে রেখে সুগন্ধার এক বছরের ইতিহাস বললাম মন্ত্রীকে প্রায় এক নিঃশ্বাসে। আমার কথা শেষ হলে মন্ত্রী ডান দিকে একটু কাত হলেন। আমি ভাবলাম, এই বুঝি জুতা হাতে নেবে অথবা কশিয়ে চড় দেবার মোমেমটাম তৈরি করছে! ব্যারিস্টার হাসনাতের কাছে শুনেছি, ডেসপারেট মুক্তিযোদ্ধা জাফর ইমামের চড়থাপ্পর যারা খেয়েছেন তাদের মধ্যে একজন সচিবও আছেন। মন্ত্রীর চর খেয়ে বেচারা সচিব ছুটে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদের কাছে নালিশ করতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে মন্ত্রী জাফর ইমাম ভিজিটরস রুমে আগে থেকেই রুমে বসা। সেখানে আবার চড় খাওয়ার দশা হলো তার। অবস্থা বেগতিক দেখে সচিব ‘অনুতপ্ত হওয়ায় দ্বিতীয়বার আর তাকে চড় খেতে হয়নি। ভাবলাম, সেই চড় এবার আমাকে খেতে হবে! কিন্তু তা নয়। ডানে ঝুকে মন্ত্রী কলিং বেল টিপলেন। তখন রিমোর্ট কন্ট্রোল বেল ছিলো না; টেবিলের সঙ্গে সুইস ফিক্স করা থাতকতো। কবরের নীরবতা ভঙ্গ করে শব্দ হলো। চিরকাল শুনে আসছি কলিং বেলের শব্দ কাকের ডাকের মতো বিরক্তিকর ও কর্কশ। কিন্তু সেদিন এই কলিং বেলের শব্দই আমার কাছে মনে হয়েছিলো গভীর রাতে গীর্জার ঘণ্টাধ্বনির মতো পবিত্র। পিয়ন প্রায় ছুটে কক্ষে প্রবেশ করলো; যেনো কাউকে বাঁধতে হবে; এমন তার ভাব। মন্ত্রী বললেন, “কফি। কিন্তু পিয়ন যেনো শুনতে পায়নি- এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। মন্ত্রী ধমক দিয়ে বললেন, কফি আর বিস্কুট দাও। মনে হলো, পিয়ন খুবই হতাশ হয়েছে। সে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো। এদিকে সৈয়দ মোয়াজ্জেম আরার মুখর হলেন, এবার তিনি মুখরা রমনীকেও যেনো হার মানালেন। কিন্তু মন্ত্রী তার কথায় কান দিচ্ছিলেন বলে মনে হলো না। এর মধ্যে কফি-বিস্কুট এলো। কোনোরকম আপ্যায়ন পর্ব সেরে আমরা মন্ত্রীর রুম থেকে বের হলাম; সে এক নরকের দরজা থেকে ফিরে আসার মতো অনুভূতি।
বিপদ কেটে যাওয়ায় একটু মজা নেবার ইচ্ছা করলো। নাটকীয় অতি বিনয়ের সঙ্গে মোয়াজ্জেম সাহেবকে বললাম, তা হলে পত্রিকা বন্ধের কথা জানিয়ে দেই; দোতলায় সাত্তারের রুমে গিয়ে ফোন করি? সাত্তার মিয়াজী ছিলো জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা; বাবলু ভাইর ওপর তার বেশ প্রভাব ছিলো। এ কারণে মোয়াজ্জেম সাহেব তাকে বেশ সমীহ করতো এবং প্রায়ই তাকে বলতো, আপনি মিলিওনিয়ার হবেন সাত্তার ভাই। আমার প্রস্তাবের উত্তরে সৈয়দ মোয়াজ্জেম আদুরে ধমকের সুরে বলনে, “রাখেন সাহেব; আপনারে পত্রিকা কে বন্ধ করতে বলছে?” আহারে মালিক, এমিবার মতো কত রূপ!
পরে শুনেছি, আমাদের সঙ্গে বনমন্ত্রী কর্নেল জাফর ইমাম যখন কথা বলছিলেন তখন পাশের রুমেই বসা ছিলেন মোজাম্মেল ভাই ও টিপু নামে তার ঘনিষ্ঠ রিপোর্টার রতœটি। আমরা চলে আশার পর তাদের মন্ত্রীর রুমে ডাকা হয়। সেই অতি চালাক পিয়নই ডেকে নিয়েছিলো। পিয়নরা এক অদ্ভূত প্রাণী। এরা সবকিছুই জানে, আর বোকাবোকা ভাব করে থাকে; এরা সব কিছুই আগেভাগে টের পায় এবং যার সঙ্গে কথা বলে তখন তারই আপন হয়ে যায়। এবং সেদিন মন্ত্রীর রুমে যা ঘটেছে তা অই পিয়নের কাছে শুনেছি। এখানে তা আর উল্লেখ না করাই ভালো। তবে কেবল বহু শ্রুত প্রবচন উল্লেখ করা যায়, অন্যের জন্য কুয়া খুঁড়লে তাতে নিজেকেই পড়তে হয়। নোয়খালীতে দুই তরুণী ধর্ষিত বলে সুগন্ধায় যে ভুয়া রিপোর্টটি ছাপা হয়েছিলো তাতে দেয়া হয়েছে জাফর ইমামের বোন ও জিয়াউদ্দিন বাবলুর বোনের নাম। তখন জাফর ইমাম ডাকসাইটে মন্ত্রী, যার হাতের চড়থাপ্পর অনেকে খেয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। আর জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী; মোয়াজ্জেম সাহেবের ব্যবসা ছিলো জ্বালানি খাতের। মানে তার প্রাণ ভোমরা ছিলো জিয়াউদ্দিন বাবলুর হাতে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পিয়নকেও সৈয়দ মোয়াজ্জেম সমীহ করে চলতেন, পারলে স্যার বলে। এ অবস্থায় মন্ত্রী তো অনেক বড় বিষয়। ভুয়া খবর প্রকাশ করে-এই মন্ত্রী খেপানো; ভালো ছক সাজিয়ে ছিলো ষড়যন্ত্রকারী। কিন্তু এ ব্লুপ্রিন্ট মাঠে মারা গেলো অতি উৎসাহের কারণে।
পত্রিকাটির উল্লেখিত ভুয়া রিপোর্ট প্রথমে চোখে পড়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুর। তিনি বিষয়টি জানান জাফর ইমামকে। এর কিছুক্ষণ পরই টিপু নামের নব্য রিপোর্টার প্রবেশ করে কর্নেল জাফর ইমামের রুমে। মোজাম্মেল ভাইর ঘনিষ্ঠ সহচর টিপু সুগন্ধার একটি কপি মন্ত্রীর টেবিলে রেখে খুবই উত্তেজিতভাবে বললো, “মামা দেখেছেন সুগন্ধায় খালার ব্যাপারে কি লিখেছে!” উত্তরে মন্ত্রী শান্তভাবে বললেন, “এ নাম যে তোমার খালার তা কিভাবে জানলে?” এ প্রশ্নে উত্তর দিতে পারেনি টিপু। কারণ জাফর ইমাম ছিলো তার এলাকার ডাকা মামা। ‘ডাকাতো মামার বোনের নাম জানার কথা নয়। টিপুর ভূমিকায়ই জাফর ইমাম প্রকৃত খেলা বুঝে ফেলেছিলেন। তা না হলে, যা গিয়েছে টিপু আর মোজাম্মেল ভাইয়ের ওপর, তা যেতে পারতো সৈয়দ মোয়াজ্জেম ও আমার ওপর। ফাও পাওনা হিসেবে মৃত্যু হতো সাপ্তাহিক সুগন্ধার। কর্নেল জাফর ইমামের মেধা ও বিচক্ষনতায় আমরা হেনস্থা হবার হাত থেকে রক্ষা পেলাম, আর অসময়ে অনিবার্য মৃত্যু থেকে বেঁচে গেলো লাখো পাঠকের প্রিয় সাপ্তাহিক সুগন্ধা। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল জাফর ইমাম বীর বিক্রম, আপনাকে সালাম!
আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন