‘এডিস মশা তো আপনার ঘরেই জন্মে’

মহিউদ্দিন মাহী
  প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০১৭, ০৮:১৬| আপডেট : ০৮ জুলাই ২০১৭, ১১:০২
অ- অ+

চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই রোগ মহামারি আকার ধারণ না করলেও রোগের ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এই রোগে আতঙ্কিত এবং পেনিকড হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি নেই। বর্ষা মৌসুমে এডিস মশাবাহিত রোগটির প্রবণতা এখন একটু নিচের দিকে। তবে এই রোগ থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় সচেতনতা। চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু নিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সাব্রিনা ফ্লোরার মুখোমুখি হয়েছে ঢাকাটাইমস।

সাক্ষাৎকারে মীরজাদী সাব্রিন ফ্লোরা বলেছেন, ‘এডিস মশা নিধন না করলে চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর এ মশা নিধনে ব্যক্তি, পরিবার এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কারণ এই মশাটি আপনার ঘরেই জন্মায়। আর নিধন আন্দোলন শুরু করতে হবে ঘর থেকেই।’

অধ্যাপক মীরজাদী সাব্রিনা ফ্লোরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ থেকে পিএইচডি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন রোগতত্ত্বের এই গবেষক। নিচে আইইডিসিআরের পরিচালকের সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:-

ঢাকাটাইমস: এখন তো চিকুনগুনিয়ার ছড়াছড়ি

ডা. ফ্লোরা: এপ্রিল-মে’র দিকে এর প্রভাব বেশি ছিল। এডিস অ্যালবোপিকটাস ও এডিস ইজিপ্টি-এই দুই ধরনের মশার কামড়ে সাধারণত চিকুনগুনিয়া হয়। রাজধানী বা শহরাঞ্চলে মূলত এডিস ইজিপ্টি বেশি থাকে, আর গ্রামে এডিস অ্যালবোপিকটাস। কিন্তু এখন এটির ট্রেন্ড নিম্নগামী। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে চিকুনগুনিয়া কমতে শুরু করেছে। এটি নিয়ে শুধুই আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। এটি নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর কিছু নেই।

ঢাকাটাইমস: কেন আতঙ্কিত হবে না মানুষ?

ডা. ফ্লোরা: কারণ চিকুনগুনিয়ায় মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি নেই। আর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। চিকুনগুনিয়ার চেয়ে ডেঙ্গু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

ঢাকাটাইমস: আমরা তো সবাই চিকুনগুনিয়া নিয়েই কথা বলছি।

ডা. ফ্লোরা: আসলে চিকুনগুনিয়া আমাদের দেশে প্রথম। আর এটিতে আক্রান্ত ব্যক্তির কষ্ট অবর্ণনীয়। একারণেই এটি নিয়ে বেশি আলোচনা। আর ডেঙ্গু আমাদের দেশের পুরো রোগ। এ সম্পর্কে সবই মোটামুটি অবহিত। এ রোগে আক্রান্ত হলে কী করতে হবে তাও অনেকেই মোটামুটি বোঝে। এজন্য এটি নিয়ে আলোচনা নেই।

ঢাকাটাইমস: ডেঙ্গু প্রতিরোধে আলাদা কোনো প্রস্তুতি আছে?

ডা. ফ্লোরা: ডেঙ্গু প্রতিরোধে আলাদা কোনো প্রস্তুতি নেই। যেহেতু ডেঙ্গুও এডিস মশা থেকে জন্মায় তাই চিকুনগুনিয়া নিয়ে যে প্রস্তুতি আছে সেটি কনটিনিউ করলেই চলবে।

ঢাকাটাইমস: ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঝুঁকি কেন বেশি?

ডা. ফ্লোরা: ডেঙ্গু তো মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে অনেক সময় রোগী মারা যায়। অনেক সময় দেখা গেল শরীর ব্যথা করছে সে ব্যথানাশক ওষুধ খাচ্ছে। এটা কিন্তু ঠিক নয়। ডেঙ্গু হলে ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না। যারা এই ভুল ওষুধ খায় তারাই বিপদে পড়ে।

ঢাকাটাইমস: অল্প সময়ে চিকুনগুনিয়া বেশি ছড়াচ্ছে কেন?

ডা. ফ্লোরা: সারা বিশ্বেই চিকুনগুনিয়া রোগের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি যখন হতে শুরু করে তখন এর প্রবণতা বাড়তেই থাকে। অর্থাৎ যখন হবে তখন হতেই থাকবে- এটি এই রোগের একটি ‘কমন ক্যারেক্টর’। এটিকে বৈশ্বিকভাবে বলা হয় ‘মিলিয়নস কেইস।’ আমরা এটাকে মিলিয়নস বলতে চাই না। আমরা বলি যখন হবে তখন অনেক কেইসই ঘটবে।

ঢাকাটাইমস: এই রোগটি প্রতিরোধে ব্যবস্থা কী?

ডা. ফ্লোরা: চিকুনগুনিয়া রোগটি কিন্তু আমাদের দেশে নতুন ফেনোমেনা। এটির সঙ্গে আমরা আগে পরিচিত ছিলাম না। নতুন করে পরিচিত হচ্ছি। এটি প্রতিরোধে আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। আর প্রতিরোধের ফল এখনই পাওয়া যাবে না। এর ফল পেতে একটু সময় লাগবে।

ঢাকাটাইমস: কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?

ডা. ফ্লোরা: এই রোগ প্রতিরোধে আমাদের মেডিকেল টিম কাজ করছে। সবচেয়ে বড় যে পদক্ষেপ সেটি হচ্ছে- দেশব্যাপী সচেতনতা তৈরি করা। যত কিছুই করি না কেন আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে এ থেকে মুক্তি মেলা ভার।

ঢাকাটাইমস: কী ধরনের সচেতনতার কথা বলছেন?

ডা. ফ্লোরা: যেহেতু মশার কারণে রোগটি ছড়িয়ে থাকে, তাই মূল সতর্কতা হিসেবে মশার কামড় থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন ঘরের বারান্দা, আঙিনা বা ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে পানি পাঁচ দিনের বেশি জমে না থাকে। এসি বা ফ্রিজের নিচেও যেন পানি না থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে । যেহেতু এই মশাটি দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনের বেলায় কেউ ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা মারার জন্য স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ছোট বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট পরাতে হবে, আর সবার খেয়াল রাখতে হবে যেন মশা ডিম পাড়ার সুযোগ না পায়। এই বিষয়টি যদি আমরা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে নিশ্চিত করতে পারি তাহলেই চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু রোগ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি।

ঢাকাটাইমস: ডেঙ্গু থেকেও কি এভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?

ডা. ফ্লোরা: অবশ্যই। কারণ ডেঙ্গুও এডিস মশা থেকে জন্মে। সুতরাং এই মশায় কামড়ালে চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু উভয় রোগই হতে পারে। একারণে আমাদের কাছে এই ধরনের রোগী আসলে আমরা সেম্পল নেয়ার সময় দুই ধরনের পরীক্ষা করি। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া উভয় পরীক্ষাই আমরা এক সঙ্গে করে ফেলি।

ঢাকাটাইমস: আপনাদের এই ধরনের পদক্ষেপ কতদিন পর্যন্ত চলবে।

ডা. ফ্লোরা: এডিস মশা যেহেতু বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাই আমরা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের পদক্ষেপগুলো চালিয়ে যাবো। বর্ষা মৌসুম শেষ হয়ে গেলে আর এই ধরনের রোগের সম্ভাবনা থাকে না। কারণ বৃষ্টির মৌসুমেই এডিশ মশা জন্মায়।

ঢাকাটাইমস: এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া রোগী সংখ্যা কত?

ডা. ফ্লোরা: আমরা এ পর্যন্ত ৫৫২ জন রোগীর চিকুনগুনিয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত হতে পেরেছি।

ঢাকাটাইমস: এই রোগ থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে কবে থেকে?

ডা. ফ্লোরা: এই রোগ থেকে মুক্তি নেই। একমাত্র মুক্তি মিলতে পারে এডিস মশা নিধন করা গেলে। মশা যতদিন সম্পূর্ণরূপে নিধন হবে না ততদিন চিকুনগুনিয়া থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব নয়। মানুষ থেকে মশা ও মশা থেকে মানুষে চিকুনগুনিয়া ছড়ায়। যেখান থেকে জীবাণু ছড়ায় সেটাকে বলে সোর্স অব রিজার্ভার। বের হওয়ার পথকে বলে পোর্ট অব এক্সিট। চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে পোর্ট অব রিজার্ভার হলো আক্রান্ত মানুষ। আর পোর্ট অব এক্সিট হলো মশার কামড়। মশার কামড় থেকে বাঁচতে তাই বিশেষ সতর্কতা হিসেবে আলাদা মশারি ব্যবহার করা উচিত। এটা কনট্রোল মেজর হিসেবে কাজ করতে পারে।

ঢাকাটাইমস: মশা নিধনই মূল কাজ আপনি বলেছেন। সিটি করপোরেশন মশা নিধনের দায়িত্বে। মশা নিধনে এই সংস্থার গাফিলতি আছে কি না?

ডা. ফ্লোরা: এখানে কাউকে দায়ী করা ঠিক হবে না। গৃহপালিত মশা হচ্ছে এডিস মশা। এই মশা নিধন ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিতকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে কাউকে দায়ী করে আমরা যদি নিজের কাজটি না করি তাহলে আমাকেই ভুগতে হবে। সুতরাং দোষারোপ না করে নিজ থেকেই সচেতন হওয়া জরুরি।

ঢাকাটাইমস: ডেঙ্গু জ্বরের সঙ্গে চিকুনগুনিয়া জ্বরের পার্থক্য কী?

ডা. ফ্লোরা: ডেঙ্গুজ্বরে শরীরে কাঁপুনি ও ঘাম দেখা দেয় এবং শরীরে রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু চিকুনগুনিয়া জ্বরে শরীরে কাঁপুনি বা ঘাম দেখা দেয় না এবং শরীরে রক্তক্ষরণ হয় না। ডেঙ্গুজ্বরে রক্তের অণুচক্রিকার সংখ্যা অনেক বেশি কমে যায়। কিন্তু চিকুনগুনিয়ায় রক্তের অনুচক্রিকার সংখ্যা বেশি কমে না। একই ব্যক্তির শরীরে ডেঙ্গুজ্বর চারবার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু চিকুনগুয়িা একবার হলে সাধারণত আর হয় না।

ঢাকাটাইমস: চিকুনগুনিয়া জ্বরের লক্ষণ কী?

ডা. ফ্লোরা: জ্বর ও অস্থিসন্ধির তীব্র ব্যথা। এ দুটি উপসর্গ একসঙ্গে থাকলে চিকুনগুনিয়া হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। রক্ত পরীক্ষা করার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। রোগীর আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। কারণ এতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো তারতম্য হয় না।

ঢাকাটাইমস: এই রোগের চিকিৎসা কী?

ডা. ফ্লোরা: চিকুনগুনিয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলো নিরাময় করা। রোগীকে বিশ্রামে রাখতে হবে। জ্বর ও অস্থিসন্ধির ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শমতো জ্বর উপশমকারী ও ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। পানি দিয়ে রোগীর শরীর মুছে দিতে হবে। রোগীর পর্যাপ্ত পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে দিতে হবে।

ঢাকাটাইমস: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

ডা. ফ্লোরা: আপনাকেও ধন্যবাদ

ঢাকাটাইমস/০৮জুলাই/এমএম/জেবি

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বাউফলে তাল গাছ থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু
আ.লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য সুমন করিম গ্রেপ্তার
এনআরবি ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হলেন কামরুল ইসলাম      
ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্যাশ অফিসারদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা