নায়করাজের জীবন থেকে নেওয়া

বাছির জামাল
 | প্রকাশিত : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৯:১৩

নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় সাংবাদিকতা সূত্রেই। ১৯৯৯ সালের দিকে তিনি নতুন একটি ছবি মুক্তি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেই ছবির পরিপ্রেক্ষিতে তার একটা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম কাকরাইলে অবস্থিত তার রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন অফিসে। তুমুল জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি কী সুন্দর ব্যবহার করেছিলেন তখনকার সময়কার একজন ‘পুচকে’ বিনোদন সাংবাদিকের সঙ্গে, আজ তা ভেবে আশ্চর্য হই। এজন্যই বোধকরি সৃষ্টিকর্তা তাকে এত বড় সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আমাকে যথেষ্ট সময় দিয়েছিলেন। তার নতুন ছবি। বাইরে অনেক লোক বসা। তাদের বসিয়ে রেখেই আমাকে প্রায় এক ঘণ্টা সময় দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সেদিন তাকে অনেক প্রশ্নের মধ্যে এটিও করেছিলাম যে, জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার রহস্য কী? তিনি বলেছিলেন, ‘পরিশ্রম, পরিশ্রম ও পরিশ্রম।’ সত্যিই তিনি পরিশ্রম করে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে আইডলে পরিণত হয়ে থাকলেন।

দিন কয়েক আগে টিভি সেটের সামনে না বসতাম, তাহলে তার নিজের মুখে নিজের উত্থানকাহিনি হয়ত জানা হতো না। তার সংগ্রামবহুল জীবনকাহিনি তুলে ধরছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কাছে। দুই পর্বের জীবনীধর্মী এ সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্বই দেখা হয়েছিল। আসলে এ পর্বেই আবদুর রাজ্জাক অর্থাৎ ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘নায়করাজ’তার জীবনের কলকাতা ও বাংলাদেশ অংশের উত্থানকাহিনি বর্ণনা করেছিলেন। জন্মভিটা ছাড়া একজন ‘ভাগ্যবিড়ম্বিত অজানা ব্যক্তি’ থেকে কী করে যে নায়করাজে রূপান্তরিত হলেন, সেই কাহিনির নিটোল বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।

জিরো থেকে হিরোতে রূপান্তরিত হওয়া রাজ্জাকের আট বছর বয়সে বাবা আকবর হোসেন ও মা নিসারুন্নেসা দুজনই মারা যান। তিন ভাই, তিন বোনের সংসারে বড়রা রাজ্জাককে বুঝতেই দেননি বাবা-মায়ের শূন্যতা। ছোটবেলায় পড়তেন খানপুর হাইস্কুলে। এ কথা এখন অনেকেই জানেন, কৈশোরে রাজ্জাকের ইচ্ছা ছিল ফুটবলার হওয়ার। গোলরক্ষক হিসেবে খেলতেন ভালো। বিভিন্ন পাড়ায় হায়ার করেও নিয়ে যাওয়া হতো তাকে।

রাজ্জাক যে পাড়ায় থাকতেন, সে পাড়ায়ই থাকতেন ছবি বিশ্বাস (কাঞ্চনজঙ্ঘা, জলসাঘরসহ অসংখ্য বাংলা ছবির শক্তিমান অভিনেত্রী), সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনয়শিল্পীরা। ছবি বিশ্বাস বিপুল উৎসাহ নিয়ে আবৃত্তি শেখাতেন পাড়ার শিশু-কিশোরদের। রাজ্জাকও তার কাছে আবৃত্তি শিখেছেন। শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্কুলেই একটি নারীবর্জিত নাটক করতে চাইলেন, নাম ‘বিদ্রোহী’। স্কুলের মেয়েরাও রাজ্জাকের অভিনয়ের তারিফ করল। তাতে অভিনয়ে মনোযোগী হন রাজ্জাক। পাড়ার শক্তি সংঘ ক্লাবে অভিনয় করলেন ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে। এরপর তরুণতীর্থ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে নিয়মিত অভিনয় করা শুরু করেন তিনি। এ ক্লাবের সভাপতি ছিলেন ছবি বিশ্বাস। নাট্য পরিচালক ছিলেন পীযূষ বোস।

অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতার নাকতলায় তার জন্ম সেই ১৯৪২ সালের ২৩ আগস্ট। আশ্চর্য তিনি পরপারেও পাড়ি জমালেন এ আগস্ট মাসেই। ২১ আগস্ট সন্ধ্যায় ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ বিদায় নিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পঁচাত্তর বছরের এ কীর্তিমান পুরুষ ১৯৬৪ মালে কলকাতা থেকে চলে আসেন ঢাকায়। কলকাতায় ব্যাপক দাঙ্গার কারণে রাজ্জাকের পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা এ পারে অর্থাৎ বাংলাদেশে চলে আসবে। তারই অংশ হিসেবে রাজ্জাক পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় চলে আসেন স্ত্রী ও পুত্র বাপ্পাকে নিয়ে। তাদের সঙ্গে ছিলেন তারই এক খালুর পরিবার।

আসাদুজ্জামান নূরের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার মুখ থেকেই শুনি সেদিনকার কথা, “দাঙ্গার কারণে পরিবারের সম্মতিতে এ পারে বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। ট্রেনে খুলনা, যশোর হয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে নামি। পল্টনে আজকের যে স্টেডিয়াম, সেদিন তা ছিল নির্মাণাধীন। অন্য রিফিউজিদের মতো আমরাও সেই নির্মাণাধীন স্টেডিয়ামেই আশ্রয় নিই। সেখানে জানতে পারলাম, ভারত থেকে আগত রিফিউজিদের জন্য মিরপুরে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বাসে করে চলে গেলাম সেখানে। অনেক বড় বড় ঘর। তবে তেমন কেউ নেই। আমরা দুটি পরিবার কয়েকটি কক্ষ দখলে নিয়ে থাকলাম। সেদিন রাতে প্রচ- ঝড় হয়। এতে আমার বাচ্চা অসুস্থ হয়ে যায়। পরে সেখান থেকে ৮০ টাকা ভাড়ায় নিকটস্থ একটি বাড়িতে চলে আসি। সেখান থেকেই শুরু হয় আমার জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রাম। মঞ্চ নাটক করে, রেডিওতে খবর পাঠ করে এবং সিনেমায় পরিচালকের সহকারী হিসেবে খেয়ে না খেয়ে চলে আমার জীবন সংগ্রাম।”

তিনি বলতেই থাকেন, “একদিন অভিনয়শিল্পী মোহাম্মদ জাকারিয়া বললেন, জহির রায়হান আমাকে খুঁজছেন। জহির রায়হান তখনকার সময়কার বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক ও স্ক্রিপ্ট রাইটার। আমার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। তিনি একদিন কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন, আমাকে তার একটি ছবিতে নায়ক করবেন। আমি মনে করেছিলাম, এটা কথার কথা। একদিন তার সঙ্গে দেখা করলাম। দেখি মহাযজ্ঞ অবস্থা। আমাকে বললেন, রাজ্জাক, তুমি আমার পরবর্তী ছবি ‘বেহুলা’র নায়ক। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমার এ হতবিহ্বল অবস্থার মধ্যেই ছবি সাইন করালেন। সাইনিং মানি দিলেন ৫০০ টাকা। তখনকার সময়ে ৫০০ টাকা অনেক। এই আমার শুরু। সিনেমাটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমারও আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপর অভিনয় করলাম ‘আগুন নিয়ে খেলা’। এই ছবিটাও সুপার-ডুপার হিট। আমিও সিনেমায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলাম সুপারডুপার হিট নায়ক হিসেবে। এভাবেই বাংলাদেশের সিনেমায় আমার সেই যে পথচলা শুরু হলো আজও তা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছেই।”

জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ রাজ্জাকের জীবনের অন্যতম ছবি। এ সিনেমার জন্য নির্মাতা ও নায়ককে আর্মিদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাজ্জাক বলেছেন, “আমার কাছে মনে হয়, ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি স্বাধীনতার পূর্বঘোষণা। আমরা এফডিসির ৩ নম্বর ফ্লোরে কাজ শুরু করলাম। হঠাৎ আর্মি এসে ঘিরে ফেলল ফ্লোরটা। বলল, ‘ডিরেক্টর কে?’ জহির ভাই বললেন, ‘আমি।’ ‘অ্যাক্টর?’ বললাম, ‘আমি।’ আমাকে মূল অভিনেতা হিসেবে ভাবতেই পারছিল না ওরা। এবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে তিন ঘণ্টা ধরে জহির ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক চলল ওদের। জহির ভাই বলছিলেন, ‘আমাকে ধরে এনেছেন কোন আইনে? ছবি হলো কি হলো না, সেটা তো সেন্সর বোর্ড দেখবে।’ অনেক তর্কের পর আমরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলাম।’

স্বাধীনতার পরও রাজ্জাক ছিলেন খ্যাতির শিখরে। ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’-এর মতো ছবি করেছেন। নারায়ণ ঘোষ পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ ছবিটি ছিল ব্যতিক্রমী। ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিটির কথাও মানুষ অনেক দিন মনে রাখবে। এ ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে আছে অগ্নিশিখা, অশিক্ষিত ও ছুটির ঘণ্টা। শেষবেলার রাজ্জাকও বাজিমাত করেছেন বড়পর্দায়। তার ‘বাবা কেন চাকর’ দুই বাংলায় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

দীর্ঘ অভিনয়জীবনে তিনি সুচন্দা, কবরী, শাবানা, ববিতা, রোজিনার সঙ্গে একের পর এক সফল জুটি উপহার দিয়েছেন। ২০১৪ সালে অভিনীত ‘কার্তুজ’ তার শেষ ছবি। রাজ্জাক অভিনয় ছাড়াও পরিচালনা করেছেন। তার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘অনন্ত প্রেম’। বাংলা-উর্দু মিলিয়ে তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আছে স্বাধীনতা পদক (২০১৫), পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা অভিনেতা), মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০১৪। নায়করাজ রাজ্জাক পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সোনার হরফেই লেখা থাকবে তার নাম। তিনি অমর। মৃত্যুঞ্জয়ী।

বাছির জামাল: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :