পর্যটন শিল্পে নতুন সম্ভাবনা ইকোট্যুরিজম
দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইকোট্যুরিজম। ইকোট্যুরিজম নিরেট বিনোদনের জন্য ঘুরে বেড়ানোর চেয়েও বেশি কিছু। পর্যটনের এই নতুন ধারণায় পর্যটকগণ পরিবেশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য স্থানীয় পরিবেশ ও মানব সম্প্রদায়ের সাথে দায়িত্বশীল আচরণ করেন। সেই সঙ্গে এখানে সুযোগ থাকে প্রকৃতির সঙ্গে গভীরভাবে মিশে গিয়ে নতুন কিছু জানার ও উপলব্ধি করার। পর্যটন এলাকার স্থানীয় জনগণের জন্য ইকোট্যুরিজম পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের একটি দীর্ঘস্থায়ী সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
অন্যান্য দেশের ন্যায় পর্যটন শিল্প আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। মালদ্বীপ, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া কিংবা থাইল্যান্ডের মতো বহুদেশের অর্থনীতি পর্যটন খাতের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে।
বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ। যা ২০১২ সালে ৩৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১০ সালে পর্যটন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভ্রমণ হতে পাঁচ শ ৫৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। ২০০১ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল দুই শ ৬৫ কোটি ৩৮ লাখ।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের তথ্যানুসারে ২০১২ সালে মোট জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ আসে পর্যটন হতে এবং ২০২০ সালে তা ৪ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
পর্যটন খাত বিকাশে সাগরপথে বিশ্ব পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে বিলাসবহুল জাহাজ সিলভার ডিসকভার প্রথমবারের মতো ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার প্রায় একশ পর্যটক নিয়ে শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে যাত্রা করে ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে।
তবে পর্যটন শিল্পের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাতাসে দুষিত ধোঁয়া নিঃসরণ, বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগত হুমকির সম্মুখীন হয়। এসব কারণে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশেই ইকোট্যুরিজমের চর্চা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইকোট্যুরিজম সোসাইটির তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালে বিশ্ব বাজারের মোট ২৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ইকোট্যুরিজমের সঙ্গে জড়িত ছিল। সাধারণ ট্যুরিজম বৃদ্ধির হার যেখানে ৪ থেকে ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ সেখানে ইকোট্যুরিজম ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ইকোট্যুরিজম নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এর পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এর হার আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে ইকোট্যুরিজম এর সম্ভাবনা রয়েছে। এদেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ। এসব নিদর্শনসমূহকে ঘিরে ইকোট্যুরিজম গড়ে তোলা সম্ভব। সমুদ্রপোকূল, অরণ্য, পার্বত্য এলাকা, হাওর-নদী-খাল-বিল, দ্বীপকে ইকো-ট্যুরিস্ট কেন্দ্রে পরিণত করা যেতে পারে।
পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ইকোট্যুরিজম গড়ে তোলা যেতে পারে। এটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে পৃথিবীব্যাপী সুপরিচিত।
বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত সেন্টমার্টিন বা অনুরূপ দ্বীপকেও ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এর ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ইকোট্যুরিজমের অনুকূল। দ্বীপে উন্নতমানের কোরাল, বিরল প্রজাতির কচ্ছপ, উপকূলের শান্ত ও নীল জলরাশি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
এছাড়া সিলেটের চা বাগান, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, কুয়াকাটার মতো অনন্য প্রাকৃতিক স্থানসমূহ ইকোট্যুরিজম এর উৎকৃষ্ট কেন্দ্র হতে পারে। দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাসস্থানকে ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। বাংলাদেশের এসকল অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ঐতিহাসিক স্থান ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি উপভোগ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে বহু পর্যটক আসছেন। তাই গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থানসমূহের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার মাধ্যমে এগুলোতে ইকোট্যুরিজমের প্রসার ঘটানোর জন্য চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ইকোট্যুরিজম অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। এর ফলে স্থানীয় বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতিফলন ঘটে। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন কৃষিপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হচ্ছে। তাই সংশ্লিষ্ট সকলের কল্যাণে ইকোট্যুরিজমের ব্যাপক প্রচার ও বিপণন করতে হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করলে ইকোট্যুরিজম আরও সফল হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
(ঢাকাটাইমস/২৫সেপ্টেম্বর/এজেড)