ভালোবাসার ফাগুনে গোলাপ চাষিদের কান্না

আহমাদ সোহান সিরাজী, সাভার (ঢাকা)
 | প্রকাশিত : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:৫০

শীতের রুক্ষতা কেটে গাছে গাছে নতুন পাতার ঝলকানি। বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ এবং পাখির গান জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে। দুয়ারে কড়া নাড়ছে ভালোবাসা দিবস আর এর পরেই একুশে ফেব্রুয়ারি।

ঋতুরাজ বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে রাঙাতে প্রধান অনুষঙ্গ রঙ-বেরঙের ফুল। সব আবেদন অনুরাগ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের বড় মাধ্যম এই ফুল।

নিজেকে সাজাতে বা প্রিয়জনকে উপহার দিতে এই দিনে ব্যাপক চাহিদা থাকে ফুলের। সুবাস ও স্নিগ্ধতায় প্রিয়জনকে আরো কাছে টানে রঙিন ফুল।

এই দিনগুলো ঘিরে প্রতিবছরই বিশেষ যত্নে গাছে গাছে ফুল ফুটান বাগানিরা। রাজধানীর অদূরে সাভারের বিরুলিয়া অনেক আগেই পরিচিতি পেয়েছে গোলাপ গ্রাম হিসেবে। কিন্তু এ বছর সেই গোলাপের রাজ্যে হানা দিয়েছে অচেনা শত্রু। পচে গেছে অধিকাংশ গোলাপের কলি। তাই বড় এই দিবস ঘিরে চাহিদা মোতাবেক ফুলের যোগান নিয়ে শঙ্কার সাথে লোকসানের চিন্তায় সাভারের ১০টি গ্রামের হাজারেরও বেশি চাষি। করোনার দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া দূরের কথা এবার উৎপাদন খরচ তোলা নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা।

উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের শ্যামপুর, মৈস্তাপাড়া, সাদুল্লাপুর, বাগ্নীবাড়ি, ভবানীপুর ও বিরুলিয়াসহ অন্তত দশটি গ্রাম গোলাপ চাষের জন্য বিখ্যাত। এই গ্রামগুলো মানুষের কাছে গোলাপগ্রাম হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকায় প্রায় ২৭৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ চাষ হয়। অন্তত ১৫০০ কৃষক বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ করেন। এবার গোলাপগ্রামের হাজারো গোলাপ চাষির বাগান ছত্রাকের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে।

সরেজমিনে বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, গোলাপ বাগানে ফুটে নেই কোন গোলাপ। গাছের পাতা ও কলির পাপড়ি কালো হয়ে মুষড়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও গাছের পুরো অংশই কালো হয়ে গেছে। এতো কিছুর পরও কেউ কেউ বাগান পরিষ্কার করছেন। এছাড়া দর্শনার্থীরাও দেখতে আসছেন গোলাপের বাগান।

স্থানীয় ফুলচাষি মনির হোসেন। প্রতিবছরের মত এবারও ঋণ নিয়ে ৬০ শতাংশ জমিতে গোলাপের চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু তার সব বাগানেই কোন ফুলের দেখা পাননি। গত এক মাস ধরে বাগানের এমন করুণ পরিস্থিতিতে নির্বাক মনির হোসেন।

তিনি জানান, ২০১৭ সালে একবার এমন হয়েছিল। এলাকার সবার বাগানে অজানা রোগে গাছ আর ফুল মরে শুকিয়ে গিয়েছিল। তখন সবাই মিলে দিশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অনেক গাছ নষ্ট হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনার পর ঋণ করে আবার বাগান করেছিলাম। এই বছর আবারো ওই রকম মড়ক দেখা দিয়েছে বাগানে।

গাছের কচি ডাল, কুড়ি, কলি পঁচে শুকিয়ে গেছে। কোন কিছুই বুঝতে পারছি না। জমিতে পটাশ সার, নিড়ানি দিয়েছি, কিন্তু এতেও কোন কাজ হয়নি। বাগান থেকে কোন ফুল বিক্রি করতে পারছি না। অন্য বছর এই সময় প্রতিদিন একেকটা বাগান থেকে ২৫০০-৩০০০ করে ফুল কেটেছি। আর এই বছর তিন দিন পর আড়াইশ ফুল কাটলাম আজ। গড়ে ডেইলি ১০০ ফুলও পাই না।

তিনি আরও বলেন, এইটা আমাদের ফুল বিক্রির সিজন। আর এখনি বাগানের এই অবস্থা। একদিন পর ভালোবাসা দিবস। কিন্তু বাগানের যতদূর চোখ যায় ফুলের দেখা নাই। এখন ঋণের টাকা কীভাবে শোধ করব, সেই ভাবনাতেই দিন পার করছি।

রফিকুল ইসলাম নামে আরেক এক গোলাপ চাষির সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ৭৫ শতাংশ জমিতে গোলাপ চাষ করি। তবে করোনার লোকসান কাটিয়ে না উঠতেই আমার বাগানগুলো ছত্রাকের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে। ছত্রাকের আক্রমণে বাগানের গোলাপ গাছ, ডগা, কলি মরে ঝড়ে পড়ছে। ছত্রাকনাশক ও বাগান পরিচর্যা করেও কাজ হচ্ছে না। বাগান পরিচর্যা বাবদ এখন পর্যন্ত ১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু এক টাকারও ফুল বিক্রি করতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, মূলত ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে মার্চ মাসের পুরোটাই আমাদের গোলাপের মৌসুম। এই সময়টাতেই বাগান ফুলে পরিপূর্ণ থাকে। আমরা ফূল বিক্রি করে লাভবান হই। সামনে ভাষা দিবস, ভালোবাসা দিবস এবং ২৬ মার্চ এ সময়টায় ফুলের চাহিদা থাকে। এবছর এসব দিবসে এক টাকারও ফূল বিক্রি করতে পারব না।

এদিকে স্থানীয় বাগানে ফুল না থাকার প্রভাব পড়েছে সাভারের ফুলের দোকানগুলোয়। ভালোবাসা দিবসের দুই দিন আগে থেকেই তাদের ২০-৩০ টাকা দরে যশোর থেকে গোলাপ কিনতে হচ্ছে। এত দামে গোলাপ কিনে আরও লাভে বিক্রি করা যাবে কিনা তা নিয়ে বেশ শঙ্কাও আছে।

নবীনগর এলাকার ফুল ব্যবসায়ী ময়েজ উদ্দিন বলেন, সাভার ও যশোর থেকে আমাদের এখানে গোলাপ ফুল আসত। কিন্তু সাভারের বাগান থেকে অনেক দিন ফুল সে রকমভাবে আসছে না। এ কারণে চাহিদা বেশি থাকায় যশোর থেকে আসা ফুলের বাজার চড়া। ২০-৩০ টাকা দরে প্রতিটি ফুল আমাদের কিনতে হচ্ছে। কিন্তু ভালোবাসা দিবসে এই দামে কেনা ফুল বেশি লাভে বিক্রি করা যাবে কি না তাতে সন্দেহ আছে।

এ বিষয়ে সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ বলেন, মূলত গোলাপ এক মেয়াদি চাষ কিন্তু সাভারের গোলাপ বাগানগুলোর বয়স অনেক। এখানে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী বাগানও রয়েছে। প্রতি বছর অতিরিক্ত মাত্রায় সার প্রয়োগের কারণে মাটিতে পিএইচের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে গাছ মাটি থেকে আর খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না।

এ ছাড়া অসময়ের বৃষ্টি, কুয়াশাসহ অতিরিক্ত শীতকেও দায়ী করে তিনি বলেন, বর্তমান আবহাওয়াটা ফসল উৎপাদনের অনুকূল নয়। ফলে কচি পাতা এবং ফুল ঝরে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মাত্রায় পানি প্রয়োগও এই ধরনের সমস্যার কারণ।’

কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, আমরা কৃষকদের অতিরিক্ত পানি, সার প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছি। মাটির পিএইচ বাড়ানোর জন্য কিছু চুনজাতীয় ডলোমাইট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছি। গোলাপের জন্য যে পরিমাণ পিএইচ দরকার সেটা এর মাধ্যমে মাটিতে আনা সম্ভব। কিন্তু ওখানকার কৃষকরা আমাদের কথা শুনছেন না।

ইতিমধ্যে আমাদের ঢাকা বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কৃষি কর্মকর্তারাও গোলাপগ্রাম পরিদর্শন করেছেন। তাদের পরামর্শে রোগ নির্ণয়ে আক্রান্ত গোলাপ গাছ ও ফুলের নমুনা ‍কৃষি বিজ্ঞানীদের কাছে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আমরা গোলাপ চাষিদের পাশে আছি। উপজেলা প্রসাশনের তহবিল ও সরকারি তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত গোলাপ চাষিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে।

(ঢাকাটাইমস/১৩ফেব্রুয়ারি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :