কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
  প্রকাশিত : ০৭ মার্চ ২০২২, ০০:৫৩| আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২২, ০৯:৫৫
অ- অ+

“কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।”

কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি। বঙ্গবন্ধু আর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে কবির আবেগ উৎসারিত পঙ্ক্তি। কিন্তু ৭ মার্চের সেই ভাষণ শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তৃতার মাহাত্ম্য নয়, এটি নিজেই আরেক কবিতা- বাঙালির মুক্তির কবিতা, স্বাধীনতার কবিতা, আত্মোৎসর্গের কবিতা।

রেসকোর্সে তাঁর ১৮ মিনিটের ভাষণটি একটি জাতির স্বাধীনতার কবিতা হয়েই ফুটবে, তা বুঝে গিয়েছিলেন রাজনীতির মহান কবি। বজ্রনিনাদে ঘোষিত এই অলৌকিক মুক্তিকাব্য রচনার প্রাককালটা ঘুরে এলে তা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় আলো জ্বলেছে। বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতাও সেখানে ছিলেন। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠরা। ছাত্রনেতারা বারবারই শেখ মুজিবুর রহমানকে বলছিলেন, ‘নেতা, আপনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী রাজনীতিক। তিনি পূর্বাপর সবকিছু খেয়াল করতেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তা তিনি অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলেন।

ছাত্রদের শান্ত করার জন্য তিনি অধ্যাপক মাযহারুল ইসলামকে বললেন, ‘অধ্যাপক, আপনার এই গুণধর ছাত্রদের সামলান। এদের নিয়ে আমি আর পারছি না।’ বঙ্গবন্ধুর সামনেই বসা ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা আবদুর রউফসহ আরও কয়েকজন। আবদুর রউফ তখন নির্বাচিত পরিষদ সদস্য। বঙ্গবন্ধুর আদেশের পর অধ্যাপক তার ছাত্রদের নিয়ে কাছেই সাংহাই চীনা রেস্তোরাঁয় বসলেন। অনেক আলোচনার পর ছাত্রদের তিনি বোঝাতে সক্ষম হলেন। সবাই একমত হলো যে, ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হবে কি হবে না তা একমাত্র বঙ্গবন্ধুই সিদ্ধান্ত নেবেন। জাতির কাণ্ডারি সেদিন ছাত্রদের মনোভাবের কথা শুনে তাদের জড়িয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মাযহারুল ইসলাম]

পরদিন ৭ মার্চ সকালে ধানমন্ডির বাসায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠক ডাকেন বঙ্গবন্ধু। বিকেলে রেসকোর্সের জনসভায় তিনি কী বললেন তা নিয়ে আলোচনা হয়। জনসভা মঞ্চে পৌঁছানোর আগেই ছাত্রনেতারা ঘোষণা দেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করবেন।’ মঞ্চের পাশে বাংলাদেশের মানচিত্র-খচিত একটি পতাকাও রাখা হয়েছিল।

জনসভার জন্য রওনা দেয়ার সময় বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের নিরাশ করো না। যা বলার চিন্তাভাবনা করেই বলবে।’ বেলা সাড়ে চারটা। দোতলা থেকে নেমে এলেন শেখ মুজিবুর রহমান। উঠলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ সহচর মমিনুল হক খোকার গাড়িতে। খোকাই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পেছনে ছিল একটি ট্রাক। যেখানে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা ছিলেন। খোকা সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘চিন্তামগ্ন মিঞাভাই। গোটা জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে তিনি আজকে কি বলবেন তার ওপর।’ সবার সঙ্গেই তিনি আলোচনা করেছেন, শেষ মুহূর্তে ভাবী আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আপসকামিতার বিরুদ্ধে তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামের কথা। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো মিঞাভাইর নিজের। হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘রেডিওতে আমার বক্তৃতা প্রচার করা হবে। খায়েরকে বলিস আমার বক্তৃতার রেকর্ড যেন বের করে। আর অভাইগা তো থাকবেই ধারে কাছে ও যেন ভুল না করে, মুভি ক্যামেরায় যেন ধরে রাখে আজকের সভার সব কিছু।’ ভাষণটি রেকর্ড করেছিলেন গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এমএনএ আবুল খায়ের। তিনি এবং চিত্র প্রযোজক আব্দুল হামিদ সালাউদ্দিন ইস্ট পাকিস্তান গ্রামোফোন কোম্পানি নামে একটি রেকর্ড কোম্পানি করেছিলেন। জনসভার ভিডিওচিত্র ধারণ করেছিলেন বিখ্যাত নাট্যশিল্পী আবুল খায়ের। বঙ্গবন্ধু তাঁকেই ‘অভাইগা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন।

৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছতে যে সময় লাগে, সেদিন তার দ্বিগুণের বেশি সময় লেগেছিল। জনসভাস্থলে পৌঁছলে লাখো মানুষ স্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়। প্রায় ১০ লাখ লোকের পায়ের শব্দে ঢাকা সেদিন জেগে উঠেছিল মুক্তির চেতনায়। স্লোগানে স্লোগানে মুখর ছিল ঢাকার আকাশ-বাতাস। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরÍবাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়Íবাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ‘তোমার দেশ আমার দেশÍবাংলাদেশ বাংলাদেশ।’ ‘তোমার আমার ঠিকানাÍপদ্মা, মেঘনা, যুমনা।’

জনসভায় আসা জনতার হাতে ছিল লাঠি, রড, বাঁশ ইত্যাদি। ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পরদিন দৈনিক পাকিস্তান লিখেছে, ‘মুহুমর্ুুহু গর্জনে ফেটে পড়ছে জনসমুদ্রের উত্তাল কণ্ঠ। স্লোগানের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে। লাখো কণ্ঠে এক আওয়াজ। বাঁধ না মানা দামাল হাওয়ায় সওয়ার লাখো কণ্ঠের বজ্র শপথ। হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে পূর্ব বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের পতাকা। লাখো হস্তে শপথের বজ্রমুষ্টি মুহুর্মুহু উত্থিত হচ্ছে আকাশে।’ দেশ-বিদেশ থেকে সাংবাদিকরা এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে।

ঘড়ির কাঁটা ঐতিহাসিক সময়ে এসে ঠেকেছে। বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন সবাই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে তাঁর মুখের কথা শোনার জন্য।

“রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার।’

কলরেডির (মাইক্রোফোন) সামনে কিছুক্ষণ তিনি নির্বাক হয়ে রইলেন। বাঙালি মানুষের জাগরণ দেখে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন সময় এসে গেছে। আর অপেক্ষা নয়। মুক্ত বিহঙ্গের মতো স্বাধীনতা পেতে বাংলার মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে এসেছে। জলদগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে ৭ মার্চের ভাষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাষণ বিরল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ গণতন্ত্রের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তেমনি ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে অমর হয়ে থাকবে। দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার পুরোটা সেদিন নিংড়ে দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। আজও সেই ভাষণ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। সাহস জোগায় এগিয়ে যাওয়ার। বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব আকর হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর অমর কবিতা। জনসভা শেষে জনতা পাকিস্তানের পতাকা, ইয়াহিয়ার কুশপুতুল আগুনে পোড়ায়।

৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত হবার কথা ছিল। কিন্তু সামরিক শাসক তা বন্ধ করে দেয়। পরের দিন সকালে চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত হয়। সামরিক সরকার বাধ্য হয়ে ৮ মার্চ ঢাকা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করে।

(ঢাকাটাইমস/৭মার্চ/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ অতঃপর মন্ত্রী ফরিদুল হক খান দুলাল…
ব্যর্থতা ঢাকতে ট্রাম্প অস্বাভাবিক বাড়িয়ে বলছেন: খামেনি
এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার ৫১৩ হাজি দেশে ফিরেছেন
মুরাদনগরে ধর্ষণ: তারকাদের ক্ষোভ, প্রতিবাদ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা