ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা ও দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম যোগদানের পর থেকেই হাসপাতালে দালাল দৌরাত্ম্য রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে হাসপাতাল স্টাফদের অর্থ উপার্জন, অসৌজন্যমূলক ব্যবহার, হাসপাতাল অপরিষ্কার-অপরিছন্ন, ওষুধ চুরি এবং আউটডোরে রোগীর হয়রানি বেড়েছে। হাসপাতালের জমি বেখদখলে তার নপুংশক ভূমিকা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। হাসপাতালের স্টাফদের রোগীদের সিরিয়াল বাদেই আগে দেখে আউট ডোরে। টিকিট কেটেও অনেক রোগী ডাক্তার দেখাতে না পেরে ফিরে যান। সম্প্রতি সাপে কাটা রোগী এলে হাসপাতালে এন্টিভেনম নেই বলে অন্যত্র রেফার্ড করে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে সিজারসহ অন্যান্য অপারেশন করতে টাকা দিতে হয়। তবে এই টাকা কোন রশিদে লেনদেন হয় না বা হাসপাতালের খাতায় যোগ হয় না। হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে নিয়মিত দালাল চক্রের যাতায়াত রয়েছে। অনেক রোগীরা দালালদেরকেও হাসপাতালের স্টাফ ভেবে তাদের কাছে প্রতারিত হচ্ছে। হাসপাতালের লিফটের সামনে মাঝে মাঝে দেখা যায় গুরুর গোবর। শহরে চরে বেড়ানো গরু হাসপাতালের বিল্ডিংয়ের মধ্যে কখন প্রবেশ করে মল ত্যাগ করে রেখেছে। বর্তমানে একটি রোগী ভর্তি করতে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি কাউন্টারে ২৫ টাকা নেওয়া হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় একটি ফেরতযোগ্য গেট পাস। যদিও সেই গেটপাস আর কেউ ফেরত দেয় না। তবে গেট পাসের কোনো সিরিয়াল নম্বর না থাকায় হাসপাতাল প্রতিদিন কতগুলো গেটপাস বিক্রি করেছে তার কোন হিসাব নেই। হাসপাতালের অর্থপেডিক ওয়ার্ডে প্রায় ২৫ দিন আগে ভর্তি হয়েছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চান্দেরপোল গ্রামের মৃত ফজের আলীর ছেলে কামারুল ইসলাম। কামারুল পেশায় ভ্যান চালক। গান্না বাজার থেকে কাঁচামাল লোড করে কালীগঞ্জ যাওয়ার পথে ট্রাকের ধাক্কায় হাত ভাঙে যায় তার। অসহায় কামারুল ইসলামকে বিভিন্ন ব্যক্তি আর্থিক সহযোগিতা করে চিকিৎসার জন্য। গত ১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার তার অপারেশন করা হয়েছে সদর হাসপাতালে। অপারেশনের আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি স্লিপ দেয় ওটির জন্য। তাতে ওষুধসহ অন্যান্য ওটি সামগ্রী কেনার জন্য সাড়ে ৩ হাজার টাকা লেগেছে। এদিকে পূর্ব পরিচিত হাসপাতালের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট মো. জাকির হোসেন ডাক্তার খরচ বলে তার কাছ থেকে সাড়ে ৯ হাজার টাকা নিয়েছে। মঙ্গলবার প্রতিবেদক জাকির হোসেনের কাছে জানতে চান ডাক্তারের খরচ বাবদ যেই সাড়ে ৯ হাজার টাকা নিয়েছেন সেটার কি কোন রশিদ দিয়েছেন?
তিনি বলেন, আপনি কে? এই কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন? এতদিন কোথায় ছিলেন? আমিই তো রোগীর রক্ত দেওয়া, পরীক্ষা করা সব করে দিয়েছি। এতোদিন পরে এসে এই কথা জিজ্ঞাসা করছেন। তাহলে আপনার সবকিছু করার দরকার ছিল। এই বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালে ওটি বা ডাক্তারের কোন খরচ নেই। হয়তো প্লেট কিনতে টাকা নিয়েছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানাবেন বলে জানান। কিছুক্ষণ পরে তত্ত্বাবধায়ক প্রতিবেদকের ফোনে কলদিয়ে জানান এই টাকা জাকির নেয়নি। মিন্টু নামের একজন নিয়েছে।
এদিকে, অসুস্থ কামারুল ইসলামকে বেড থেকে তুলতে ও শোয়াতে দুইজনের সাহায্য লাগছে। জাকির হোসেন তাকে টেনে হেচড়ে নিচে তত্ত্বাবধায়কের রুমে নিয়ে যেয়ে তাকে চিকিৎসা করবে না, সুদে আসলে বদলা নেবে বলে স্বাক্ষী দেওয়ায় জাকির হোসেন টাকা নেয়নি। পরে অবশ্য বলে তাকে সাক্ষী রেখে মিন্টুকে দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানাযায়, মিন্টু হাসপাতালের কেউ নয়। সে ম্যাটসের ছাত্র। জাকির হোসেনের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে। ১১ তারিখেই হাতে সরকারি ওষুধের ব্যাগ হাতে জাকির হোসেনের দেখা হয় ঝিনাইদহের সাংবাদিক কামরুজ্জামান লিটনের সঙ্গে। তার হাতে সরকারি ওষুধের ব্যাগ কেন জানতে চাইলে তিনি হাসপাতালের স্টাফ, তিন তালায় বসি বলে চলে যান। সাংবাদিক কামরুজ্জামান লিটন বলেন, আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। হাসপাতালের ওষুধ কাউন্টারের সামনে ব্যাগ ভর্তি সরকারি ওষুধ হাতে দেখে জাকির হোসেনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
তিনি হাসপাতালের স্টাফ, তিন তলায় বসেন। ওষুধ তার কাছে থাকতেই পারে। ক্যামেরা বের করতেই দ্রুত সটকে পড়েন জাকির। অর্থপেডিক ওয়ার্ডে হাড় ভাঙা রোগীদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে সবাই টাকা নেওয়ার কথা জানান। এর প্রতিবাদ করলে চিকিৎসা হবে না বলে ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। জাকির হোসেন ছোট কামারকুণ্ড গ্রামের মো. ইদ্রিস আলীর ছেলে। সে অল্প দিনের মধ্যে ছোটকামারকুণ্ডু, লাউদিয়া ও ভড়ুয়াপাড়া মৌজায় কয়েক দাগে জমি কিনেছে বলে জানা গেছে।
এলাকার লোকজন ও হাসপাতালের অন্য স্টাফদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, জাকির হোসেনের এটি নতুন অভ্যাস নয়। সে ওষুধ চুরি, প্রতারণার মাধ্যমে রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে অনেক টাকা পয়সা বানিয়েছে। এলাকায় বাড়ি বলে সে কাউকে তোয়াক্কা করে না। এদিকে, হাসপাতালের কোন রোগীকে ছুটি দিলে ছাড়পত্র নেওয়ার সময় ৫০ টাকা করে নেয় ওয়ার্ড বয়রা। ছাড়পত্রের জন্য বিকাল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় রোগী ও তাদের স্বজনদের। এখন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের এটায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাকির হোসেনের কাছে টাকা নিয়েছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশন করলে এই অপারেশন করতে ৬০ হাজার টাকা লাগতো। অসহায় কামারুল ইসলাম বলেন, আপনি অভিযোগ দেওয়ায় আমাকে টেনে হেচড়ে নিচে নিয়ে গেছে। আবার কিছু বললে আমার চিকিৎসা করবে নানে। যা হয়েছে হয়েছে বাদ দেন। হাসপাতালে ডাক্তার কোন রোগীকে প্রেসক্রিপশন দিলে ওয়ার্ড বয়েরা বেশি করে লিখে ওষুধ কিনে নার্স রুমে দিয়ে আসতে বলে। কোন ওষুধ ব্যবহার হলো কোন ওষুধ লাগলোই না এমন খোঁজও থাকে না রোগীর স্বজনদের। এই ওষুধ তারা আবার বিক্রি করে দেয়। এছাড়াও হাসাপাতালে বিভিন্ন অনিয়ম নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। হাসপাতালে সরকারি ওষুধ বিতরণেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে রোগীদের যেই পরিমাণ ও প্রকারের ওষুধ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে হাসপাতাল থেকে সেই পরিমাণ ওষুধ দেওয়া হয় না। এই কারচুপিতে মোটা অংকের টাকা উঠছে সিন্ডিকেটের হাতে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কাছে অভিযোগ দিলেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায় না। তিনি সাংবাদিকদের কাছে দ্বায় এড়ানো বক্তব্য দিচ্ছেন যে তার কিছু করার নেই। এছাড়া হাসপাতাল আঙিনায় প্রতিদিন বাইসাইকেল-মোটরসাইকেল ও হেলমেট চুরির ঘটনা তো আছেই। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে জেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা হাসপাতালে দালাল দৌরাত্ম্য, অনিয়ম, রোগী হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধ করে মানুষের সেবায় সঠিকভাবে কাজে লাগাতে জেলা প্রশাসন, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
(ঢাকাটাইমস/১৬ফেব্রুয়ারি/এআর)

মন্তব্য করুন