রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায়

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৩৪

ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ, ভেজাল খাদ্য, ঘন ঘন ইউরিন ইনফেকশন ছাড়াও বিভিন্ন কারণে কিডনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিডনি রোগের চিকিৎসায় ডায়েটের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখন পর্যন্ত ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ওষুধ বের না হলেও যথাযথ পথ্য নিয়ন্ত্রণ করে কিডনিকে বিশ্রাম দিতে পারলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

মাংসপেশির ক্রিয়েটিন ফসফেট ভেঙে তৈরি হয় ক্রিয়েটিনিন। এটা শরীরে সর্বদা একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে তৈরী হতে থাকে। তবে এটা পেশীর ভর বা ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। সাধারণত ক্রিয়েটিন জৈবিক পদার্থ পাকস্থলীতে তৈরি হয়। এরপর এটি পেশিতে যায়, যেখানে শক্তির প্রয়োজনে এটি ব্যবহার করা হয়। যেটা ব্যবহৃত হয় না, সেটা ক্রিয়েটিনিন বা বর্জ্য পদার্থে পরিণত হয়।

প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন খেলেও এই পদার্থটি শরীরে উৎপন্ন হয়। রক্তের মাধ্যমে এই ক্রিয়েটিনিন কিডনিতে পৌঁছায়, যেখান থেকে আমাদের শরীর সেটা মূত্রের মাধ্যমে বের করে দেয়। কিডনি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে শরীরে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। শরীরে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে গেলে সেটা কিডনির রোগের ইঙ্গিত করে। মানবশরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কিডনি ঠিকমত কাজ করছে না।

কিডনি বিকল রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও প্রাথমিকভাবে রক্তের ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন এবং ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা করা হয়৷ কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তের ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যায়৷ পটাশিয়ামের পরিমাণ বাড়তে থাকে ও বাইকার্বোনেট কমে যায়৷ এছাড়াও ফসফেট শরীরে জমতে শুরু করে, যার ফলে ক্যালসিয়াম কমে যেতে বাধ্য হয় এবং অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও শুরু হতে থাকে৷ এরপরে কি কারণে ধীরগতিতে কিডনি বিকল হয়েছে তা বের করার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করে এ্যালবুমিন আছে কিনা তা দেখা হয় এবং লোহিত ও শ্বেত কণিকা আছে কিনা তাও দেখে নেয়া হয়৷ প্রয়োজনে ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণও দেখা হয়।

ক্রিয়েটিনিন মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। মূত্রত্যাগের নানা সমস্যা (বারবার হওয়া, যন্ত্রণা বা রক্ত থাকা)। পেশিতে টান, ক্লান্তি লাগা, গা গুলানো এবং বমি আসা। চোখের চারপাশে ফোলা ভাব। পায়ের পাতা এবং গোড়ালিতে ফোলা ভাব দেখা দেয়।

ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা হলো প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে ০.৬ থেকে ১.২ মিলিগ্রাম/পার ডেসিলিটার। প্রাপ্তবয়স্ক নারী: ০.৫ থেকে ১.১ মিলিগ্রাম/পার ডেসিলিটার। টিনএজার: ০.৫ থেকে ১ মিলিগ্রাম/পার ডেসিলিটার। শিশু: ০.৩ থেকে ০.৭ মিলিগ্রাম/পার ডেসিলিটার।

মূলত কিছু বিশেষ রোগ হলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। যেসব রোগের কারণে ক্রিয়েটিনিন বাড়ে সেসব রোগের চিকিৎসা করালেই ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

চিকিৎসকরা যেসব রোগীদের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। সেগুলো হলো- ডায়াবেটিস আক্রান্ত, উচ্চ রক্তচাপের রোগী, কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি, যাদের পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস আছে। অটোইমিউন ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি। যাদের ঘন ঘন ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ হয়।

পরিশ্রমসাধ্য এক্সারসাইজ বা কেমোথেরাপির ড্রাগে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়াও গর্ভবতী অবস্থা বা রেড মিট বেশি খেলেও ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। জেনে নিন রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায়-

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ক্রিয়েটিনযুক্ত খাবার বেশি খান অন্যদের তুলনায় তাদের ক্রিয়েটিনিন বাড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যদি আপনার খাদ্য তালিকায় বেশি পরিমাণে দুগ্ধজাত খাবার, গরু, মহিষের মাংস বেশি থাকে তাহলে আপনার ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।এ কারণে প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার পরিবর্তে নিয়মিত খাদ্য তালিকায় শাকসবজি রাখুন। এটি আপনার ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।

অ্যাপল সিডার ভিনেগার ক্রিয়েটিনিনের লেভেল নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এই ভিনেগারে থাকা অ্যাসিটিক এসিড কিডনিতে পাথর জমতে বাঁধা দেয়। ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিদিন এক গ্লাস হালকা গরম পানিতে এক চামচ অ্যাপল সিডার ভিনেগার যোগ করে পান করুন। যেকোন বেলায় খাবার পরে এটা খেতে পারেন।

চারুচিনি ক্রিয়েটিনিন লেভেল নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কারণ এটা প্রাকৃতিক ভাবে প্রসাবের পরিমাণ বাড়ায়। যেকোন ধরনের পানীয়র সঙ্গে প্রতিদিন আধা চামচ দারুচিনির গুড়া বা এক টুকরো দারুচিনি প্রতিদিন চিবিয়ে খেলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খান। ফাইবার শরীর থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার খান অন্যদের তুলনায় তাদের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।

শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা তখনই বেড়ে যায় যখন আপনার মাংসপেশী অবিরাম কাজ করতে থাকে। এ কারণে খুব বেশি পরিশ্রম করা ঠিক নয়।

যারা শরীরে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ কমিয়ে কিডনির কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছেন, তাদের ক্রিয়েটিন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে খাবারে ফাইবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার ফলে ক্রনিক কিডনির রোগীদের ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ কমানো গেছে। বিভিন্ন ফল, সবজি, দানা শস্য ইত্যাদিতে বেশি পরিমাণে ফাইবার থাকে।

নিজের চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন যে সারাদিনে পানি ও অন্যান্য পানীয় মিলিয়ে কতটা জলীয় পদার্থ আপনি গ্রহণ করতে পারেন এবং দিনের কোন সময়ে এগুলো গ্রহণ সবথেকে উপযোগী হবে। তবে মেপে মেপে ২-৩ লিটার পানি পান নিশ্চিত করতেই হবে। তা না হলে গোপনে তৈরি হবে ডিহাইড্রেশন। পরিণতিতে বেড়ে যাবে ক্রিয়েটিনিন। দিনে ৮-১০ গ্লাসের হিসাবটা মেনে চললেই যথেষ্ট।

খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ হাই ব্লাড প্রেশারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রসেসড ফুডে সোডিয়াম ও ফসফরাসের পরিমাণ বেশি থাকায় তা কিডনির সমস্যা তৈরি করে। তাই সবসময় আনপ্রসেসড ফুড যা বিভিন্ন মশলা ও ভেষজ দিয়ে রান্না করা, তা খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।

নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগ, যা কিনা ওভার দ্য কাউন্টার পেইন কিলারস, তা যদি অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া হয়, তাহলে তা কিডনির খুব ক্ষতি করে। আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। তিনি আপনার ব্যথা যন্ত্রণা কমানোর সঠিক উপায়ে চিকিৎসা করবেন।

ক্রিয়েটিনিন বাড়াতেও ধূমপান ও অ্যালকোহলের জুড়ি নেই। পাশাপাশি ভারী ব্যায়ামও করতে নিষেধ করেছেন গবেষকরা। বিশেষ করে ওয়েট লিফটিং, সার্কিট ট্রেনিং-এর মতো ব্যায়ামগুলোও নাকি শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর তাই কিডনি সচেতনদের খানিকটা হালকা গোছের ব্যায়ামে নজর দিতে বলা হচ্ছে।

এমন খাবার নির্বাচন করতে হবে, যেসব খাবারে সোডিয়াম ও পটাসিয়াম কম থাকবে। কলা, ডাবের পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম থাকে। খই কার্বজাতীয় হওয়ায় ক্রিয়েটিনিন নিয়ন্ত্রণে এটি অসম্ভব ভালো কাজ করে। ভুট্টা, পপকর্ন এগুলোও ভালো কাজ করে। কার্বোহাইড্রেট-জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে।

পটাসিয়ামযুক্ত খাবার, ফসফরাসযুক্ত খাবার এবং সোডিয়ামযুক্ত খাবার পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। যে ধরনের খাবারে পটাসিয়ামের মাত্রা কম আছে, সেগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।

আলুর মধ্যে অনেক পটাসিয়াম থাকে। এটার দিকে অনেকে নজর দেন না। অধিকাংশ মানুষ মনে করে থাকে, ডাল বা ডালযুক্ত খাবার বন্ধ করে দিলে বা প্রোটিন গ্রহণ কম করলে এটা ঠিক হয়ে যাবে। শিম, বরবটি, পেঁপে, মূলা, গাজর, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালং শাক, কলিজা, গরুর মাংস, যে কোনও ডাল বা ডালের তৈরি যে কোনও খাবার—যাদের রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা ১.২-এর ওপরে চলে গেছে, তাদের অবশ্যই এ খাবারগুলো বন্ধ করতে হবে।

প্রতিটি খাবারের বিকল্প খুঁজে বের করা প্রয়োজন। রোগীদের জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডায়েট দিতে হবে। তবেই ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমানো সম্ভব।

(ঢাকাটাইমস/১০ এপ্রিল/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :