নির্বাচনের হালহকিকত

সম্মানিক পাঠক আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে, জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে বিদেশি দূতাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিক্ষিপ্তভাবে মতামত দিয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার তাদের বক্তব্যের বিপরীতে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। সরকার দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ভিয়েনা কনভেনশন মেনে বক্তব্য প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছে। এর পর হতেই দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশী বন্ধুদের তেমন কথা বার্তা নেই, আলোচনাও নেই। তারা বিভিন্ন জায়গায় বলছেন, তারা চায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হউক। সরকারও বলছে, তারা যে কোন পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকারের যুক্তি হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে যথাসময়ে নির্বাচনের বিকল্প নেই। আর নির্বাচন কিভাবে পরিচালিত হবে তা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানে বর্ণিত রয়েছে।
সরকার এঁও বলছে, সংবিধান মোতাবেক সরকার নির্বাচন পরিচালনা করবে। তাহলে বিদেশী বন্ধুরা কোনভাবেই সরকারকে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দোষারোপ করার সুযোগ নেই। কেননা তাদের প্রত্যাশা এবং সরকারের চাওয়া কিন্তু সমান্তরালে রয়েছে। কিংবা তাদের দোষারোপ করলেই কি কিংবা না করলেই কি? এখানে সকল কিছুর এখতিয়ার জনগণের। জনগণ যদি সরকারকে লাল কার্ড দেখায় তাহলে সরকারের আর কিছু করার থাকে না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই মূলত সকল কিছুর চালিকাশক্তি। কাজেই বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া ব্যতীত শাসন ব্যবস্থায় কোনরূপ পরিবর্তন আসবে না।
ধরুন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কি বাংলাদেশের কথা বলার সুযোগ রয়েছে? এ ব্যাপারে আপনারা সবাই একমত হবেন যে, ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কথা বলার সুযোগ নেই। ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তাদের দেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের বাইরে যেয়ে তারা কিছুই করে না, আবার সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তাদের দেশের পার্লামেন্টে সংশ্লিষ্ট বিষয় উত্থাপিত হয়ে পরিবর্তনের ব্যাপারে সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রচলিত নিয়ম এমনটাই এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংসদেই সকল কিছুর সমাধান হয়ে থাকে।
তাহলে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই মনে করি; বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বাইরের দেশের বন্ধুগণ ভূমিকা রাখতে পারে। দেখা যাচ্ছে কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের দূতাবাসপ্রীতি বেড়ে যাচ্ছে। তারা মনে করছেন, দূতাবাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এ দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আদৌ কি দূতাবাসগুলোর এমন সক্ষমতা রয়েছে? পত্রিকার পাতায় কখনোই আসেনি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দায়িত্বপ্রাপ্ত দেশের সরকার কিংবা নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তাহলে অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতগণ কিভাবে আমাদের দেশের নির্বাচনকালিন সরকার নিয়ে কথা বলার দৃষ্টতা দেখায়? আমরাই কি তাদের সুযোগ করে দিচ্ছি কিংবা ভিন্ন দেশ আমাদের অভ্যন্তরীন ইস্যু নিয়ে প্রভাব বিস্তার করুক সেটি আমরা চাচ্ছি?
২০১৪ সালের নির্বাচন কিংবা ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় কি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি? সরকার কি পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করতে পারেনি? এইবার যদি আসন্ন নির্বাচনে ঐ দলগুলো অংশগ্রহণ না করে তাহলে কি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারাবে? উল্টো রাজনৈতিক দল হিসেবে দলগুলোই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি তারা প্রকারান্তরে নির্বাচনে আয়োজনে বাঁধার সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারটি দলগুলোর অগণিত কর্মী সমর্থকেরা পছন্দ করেনি, তারা মনে প্রাণে চেয়েছিল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। এ কারণে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে দল সমর্থন করে নেতা হওয়া একজন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় দল তাঁকে বহিষ্কার করেছে (রাজনৈতিক দলটি দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায়)। এ ধরনের চিত্র থেকে বোঝা যায়, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইচ্ছুক।
কেননা একটি রাজনৈতিক দলকে সবসময় আলোচনা ও কর্মসূচির মধ্যে থাকতে হয়। বিশেষ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক কর্মীদের চাঙ্গা রাখা, দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করা, সময় মতো দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠান করা প্রমুখ বিষয়ে রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব পালন করতে হয়। যে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা একটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কর্মীরা সবসময়ই প্রত্যাশা করে দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে দলীয় শক্তিমত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি দলের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে জায়গায় যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থাকে তারা মূলত এ ধরনের সুযোগ হতে বঞ্চিত হয়।
ইদানিং দেখা যাচ্ছে; বিদেশী বন্ধুদের সুর নরম হয়েছে এবং তারা এখন নির্বাচনকালিন সরকারের মধ্যে নেই। তারা এখন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে সরকারের সঙ্গে; সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠকে মিলিত হচ্ছে। প্রত্যেকেই একই সুরে নির্বাচন আয়োজনে নিরপেক্ষতার ব্যাপারে জোর প্রদান করছেন। সরকারের প্রধানও বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতায় বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী এ দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচন নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে সরকার সকল ধরনের সহযোগিতা করবে নির্বাচন কমিশনকে। কাজেই এ দিক দিয়ে একটি জায়গায় স্ট্যাবল হওয়া গেছে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সংশ্লিষ্টরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে, সকল প্রকারের ভেদাভেদ পেছনে ফেলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের উৎসবে শামিল হতে সংবিধানের আলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে দলগুলোর আহবানে সাড়া দিয়ে নির্বাচন আয়োজনের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। অবশ্য যে সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের আহবানে সাড়া দিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে না, তাদের দাবি দাওয়া সম্বন্ধে নির্বাচন কমিশন ওয়াকিবহাল না থাকার দায় রাজনৈতিক দলকে দিতেই হবে। কেননা, নির্বাচন কমিশন যেহেতু নির্বাচন আয়োজনের সকল প্রকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত সেহেতু নির্বাচনমুখী দলের উচিত হবে নির্বাচন কমিশনের আহবানে আলোচনায় বসা।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে, অব্যাহত উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে; কোন অশুভ শক্তি যেন তাতে হানা দিতে না পারে। সেই লক্ষ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে আলোচনায় বসে সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে মতামত প্রদান করে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করা। দেশের অধিকাংশ মানুষই রাজনৈতিক স্থিতি প্রত্যাশা করে, রাজনৈতিক স্থিতির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।
লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন