কুয়াকাটা উপকূলে একমাত্র নদীটির ভরাট-দখল যেন থামছেই না

আব্দুল কাইয়ুম, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)
  প্রকাশিত : ২৯ জুলাই ২০২৩, ২৩:৩৯| আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৩, ২৩:৪৩
অ- অ+

পটুয়াখালীর মহিপুর থানার লতাচাপলী-মহিপুর এবং ধুলাসার-ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া খাপড়াভাঙ্গা নদীটি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় দিনে দিনে মরে যাচ্ছে। নদীটি বাঁচাতে নেই কোনো মহলের তৎপরতা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দু’পাশের দখলদাররা গলাটিপে হত্যা করছে নদীটি। ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশ নষ্টসহ নদীটি ভরাটের কবলে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক নাব্য হারিয়েছে। এতে ইতোমধ্যে উপকূল অঞ্চলে এর বৃহৎ প্রভাব বিস্তার হয়েছে। ভবিষ্যতে নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ার ব্যাপক আংশকা রয়েছে বলে পরিবেশবিদদের অভিমত।

সরকারের প্রতিনিধিরা এই নদীটি খনন করার আশ্বাস দিয়ে আসলেও দীর্ঘ বছর অতিক্রমের পরও কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। তবে কবে নাগাদ তা আলোর মুখ দেখবে তা নিশ্চিত করতে পারেনি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কেউ নেয়নি নদীটি খনন করার উদ্যোগ। কেউ শুনছে না নদীটির বাঁচার আকুতি। ফলে দখল, দূষণ ও ভরাট হয়ে মরে যাচ্ছে দু’মাথা সমুদ্রে মিলিত দোনটি।

নদী বাঁচাও আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, নদীর জলপ্রবাহের সাথে আমাদের জীবন জীবিকা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নদীর পানিপ্রবাহ থেমে গেলে আমাদের জীবনও থেমে যাবে। সভ্যতার মূল শিকড় হলো নদী। নদী তীরেই যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতায় সেটা থমকে গেছে। একে চলমান করার জন্যই কাজ করছে ‘নদী বাঁচাও আন্দোলন’।

উপকূলের মৎস্যজীবী জেলেরা গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করে ফিরে আসে নদীটিতে। দূর্যোগকালীন সময়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয় স্থল এ দোনটি। সমুদ্র ঝড় জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে কয়েক হাজার মাছ ধরার ট্রলার এ নদীতে এসে নিরাপদে নোঙ্গর করে। তাই খাপড়াভাঙ্গা নদীটি উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও দূর দূরান্তের জেলেদের কাছে পোতাশ্রয় নামে পরিচিত। নদীটির দু’পাড় থেকে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার মাছ দেশ-বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এজন্যই আলীপুর-মহিপুর মৎস্য বন্দরটি উপকূল অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগীতা রয়েছে।

এ নদীটি পুরোপুরি মরে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের বিভিন্ন এলাকার মৎস্যজীবী জেলেরা। বৈরী আবহাওয়ার সংকেত পেয়ে গভীর সমুদ্র থেকে জেলেরা নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবে না। এখানকার মৎস্য ব্যবসায়ীরা পড়বে বিপাকে। মৎস্য বন্দর আলীপুর, মহিপুর, কুয়াকাটার অন্যান্য ব্যবসায়ীরা পারবে না নৌপথে খুলনা, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল থেকে মালামাল আনতে। এখন শেষ ভাটায় মালবাহী ট্রলার, ষ্টিমার ও মাছ ধরার বড় ট্রলার নদীতে প্রবেশ করতে পারে না। জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় সমুদ্র মোহনায়।

গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারের জেলে আবুল কালাম বলেন, ‘আমরা গভীর সমুদ্রে ফিশিং করি। বৈরী আবহাওয়ার সংকেত পেয়ে দ্রুত এ নদীতে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারি। কিন্তু বর্তমানে ভাটার সময় প্রবেশ করতে পারছি না। জোয়ারের অপেক্ষায় ঝুকি নিয়ে সমুদ্র মোহনায় থাকতে হয়।

আরেক জেলে মোঃ নুরুদ্দীন জানান, হাজার হাজার গভীর সমুদ্রগামী ট্রলারের নিরাপদ আশ্রায়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত খনন করতে হবে। সম্প্রতি বছর থেকে ভবিষ্যতে বর্ষা মৌসুমে ঝড় জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে নদীতে কোন ট্রলার প্রবেশ করতে পারবে না।

কলাপাড়া উপজেলা ফিসিং ট্রলার মাঝি সমবায় সমিতির সভাপতি মন্নান মাঝি জানান, তারা সাগরে থাকা অবস্থায় বন্যার সংকেত পেয়ে নদীটিতে নিরাপদে আশ্রয় নেয়। এটি মরে গেলে শত শত ট্রলার কোথায় আশ্রয় নিবে এমন প্রশ্ন তারও। বর্তমানে ভরাট হয়ে ছোট হওয়ার কারণে মোহনা থেকে প্রবেশ করার সময় ট্রলার নিমজ্জিত হওয়ার ভয় থাকে।

দিন দিন যৌবন হারিয়ে নদীটি এখন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। কেন পোতাশ্রয় খ্যাত নদীটি মরে যাচ্ছে তার কারণ কেউ সনাক্ত করছে না। এমনকি খনন করা উদ্যোগও নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে শুধু নদীর দু’পাড়ে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্থাপনা উচ্ছেদ করেই দায় শেষ। ফলে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এরপরেও অদৃশ্য শক্তির জোরে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল’র কুয়াকাটা শাখার সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘নদীর জমির ভরাট করে দু’পাড়ে অবৈধ দখলদাররা আধাপাকা-পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। শেখ রাসেল সেতুর স্প্যানে স্রোতে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে নাব্যতা ধীরে ধীরে কমছে। মৎস্য বন্দরের সবধরণের অপচনশীর বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুন্দর না হওয়ার কারণে দখল-দূষণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীটি।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে প্রচন্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকার বালু ক্ষয়ে নদীর প্রবেশ মুখে চর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে খাপড়াভাঙ্গা নদীতে জোয়ার-ভাটার স্রোত কমে যাচ্ছে। স্রোত কমে যাওয়ার জন্যই নদীটির তলদেশ আস্তে আস্তে ভরাট হচ্ছে বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করছেন নদীটির দু’তীরে ট্রলার মালিকদের নোঙ্গর করে রাখা অকোঁজো পুরানো ট্রলারের বডি, বর্ষা মৌশুমে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট বোর্ড ব্যবসায়ীদের রাখা ট্রলার, মৎস্য আড়ৎদার ব্যবসায়ীদের গদিতে মাছ ওঠানোর জেডি, বরফকল মালিকদের বরফ নামানোর জেডি, এসকল জেডির পাড়ে নদীর তীরের নির্মিত রাস্তা, নদীর পাড়ে বাঁশ ব্যবসায়ীদের রাখা বাঁশ, নদীতে নির্মানাধীন শেখ রাসেল সেতুর স্প্যান ও অবৈধ দখলদারদের স্থাপনার জন্য স্রোত বাধা প্রাপ্ত হয়ে পলি জমে নদীটি দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দেশের অন্যতম মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরের ব্যবহৃত অপচনশীল পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে নদীতে। যার ফলে পূর্ণ যৌবন হারিয়ে ফেলছে খাপড়াভাঙ্গা নদীটি।

এদিকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক প্রভাবশালীরা নদীর তীরের মাটি কেটে বাধ দিয়ে ব্যক্তিমালিকানা জমির পরিধি বৃদ্ধি করছেন। অন্যদিকে স্থানীয়রা নদীর তীর পর্যন্ত বাধ দিয়ে বালু ভরাট করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ স্থাপনা নির্মাণ করে আসছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় সকল বাসিন্দারাও নিজনিজ বাড়ির পাশে জমির পরিধি দৃদ্ধি করনে মাটি কেটে বাধ দিয়ে নদীর তীর দখল করছেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র কলাপাড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মাননু বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ বছর পর্যন্ত খাপড়াভাঙ্গা ও আন্ধারমানিক নদীসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন নদী দখল, দূষণ ও ভরাটের কবল থেকে রক্ষার দাবিতে সামাজিক আন্দোলন করছি। নদী রক্ষা কমিটির সভায় একাধিকবার বলা হয়েছে, অবৈধ দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ করে, এদের উচ্ছেদ করে নদী দখল মুক্ত করা হউক। নদীর সাথে জলকপাট, খালও আমরা দখল মুক্ত দাবী করে আসছি। কিন্তু এর কোন অগ্রগতি আমার দেখতে পারছি না। এর জন্য আমরা হতাশা এবং বিস্ময় প্রকাশ করছি।

এবিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন’র সাথে। তিনি বলেন, নদীটি মরে গেলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে, মৎস্য ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির উপর। তিনি আরও বলেন, খাপড়াভাঙ্গা নদীর দু’পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ খনন করা খুবই জরুরী। ফলে নদীতে স্রোত বৃদ্ধি পেয়ে হারানো যৌবন ফিরে পাবে খাপড়াভাঙ্গা নদী।

কলাপাড়া উপজেলা পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন ওয়ালিদ বলেন, সারা বাংলাদেশে খাল খনন প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেই প্রকল্পে খাপড়াভাঙ্গা নদীটি খননের জন্য প্রস্তাবনা দেয়া আছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরেজমিনে তালিকা প্রস্তুত করে উচ্ছেদ করা হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৯জুলাই/এআর)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মোহাম্মদপুরে ৩৮০০ পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
সাংবাদিক সাইদুরের প্রাণনাশের হুমকির প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ 
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল সোমবার
এবার বাংলাদেশের চার টিভি চ্যানেল ইউটিউবে বন্ধ করল ভারত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা