বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী অন্তরদৃষ্টির প্রখরতা ও অলৌকিক আত্মবিশ্বাস

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাপ পশ্চিম পাকিস্তানে খুব ভালোভাবেই লেগেছিল যার ফলে লজ্জাজনকভাবে বাধ্যতামূলক আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোন। রাষ্ট্রপতির আসনে বসলেও চেয়ারটি স্থির ছিল না মোটেও। বরং সে চেয়ারে বসেই রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ভীষণ প্রকম্প অনুভব করতে থাকেন। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তিনি ১৯৬৯ এর ২৮ মার্চ সাধারণ নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দেন। বলে রাখা দরকার, নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে ঘোষণা করলেও স্বাধীনভাবে রাজনীতি করার উপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা থাকলে কৌশল পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়া এবং নেয়ার বাস্তবতায় সে সময় বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যেতেন। দুঃখের পরে সুখ কিংবা সৌভাগ্যের লক্ষ্যে আমরা দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হই। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলার ভোলা জেলায় লাখের অধিক মানুষের মৃত্যু ও প্রায় দশ লাখের বেশি মানুষের বাস্তুহারা হওয়ার কারণে এবং সময়মতো তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ত্রাণ সহযোগিতা না করায় অনিবার্য কারণে বাংলার এ অংশে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ প্রচেষ্টায় সেখানে ত্রাণের ব্যবস্থা করেন। ফলে নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পিছিয়ে যায়। পরিশেষে ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন এবং এক ব্যক্তির এক ভোট সে অর্থে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ ডিসেম্বর।
মানুষকে নিজের পক্ষে টানার অলৌকিক জাদুকরী ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। প্রায় দুই যুগ ধরে জাতীয়তাবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত করে বাঙালি জাতির মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের চেতনায় যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তিনি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন সে আত্মবিশ্বাসে তিনি নির্বাচনের পূর্ব থেকেই একটি জাতিরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রধান ব্যক্তিত্বের স্বরেই কথা বলতেন। ১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনের পূর্বে ব্রিটেনে অবস্থানকারী প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের সফরে গেলে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েও আসন্ন নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিয়ে বাঙালি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার কথা স্পষ্টভাবে জানান তিনি। যথাযথ নির্বাচন হলে বাঙালি জাতি তার পক্ষে গণরায় দেবে ৬ দফার প্রেক্ষাপটে রচিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তার আত্মবিশ্বাসকে শতভাগ পরিপূর্ণতায় আলোকিত করেন। সে সময় বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রায় লাখো বাঙালির প্রতি শুভকামনা জানান এবং বিপদে-আপদে পাশে থাকার কথা বলে আবেগঘন কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নিঃস্ব আমি, রিক্ত আমি, দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা, দিলাম শুধু তাই।’ আত্মবিশ্বাস আর প্রখর দূরদৃষ্টি লৌকিক বঙ্গবন্ধুকে প্রায়শই অলৌকিক বঙ্গবন্ধু রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটাতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলখানায় থেকে সহযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল( অবসর) জিজ্ঞেস করেছিলেন, আগামীতে কী পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে! এমন প্রশ্নের জবাবে জনরোষে পড়ে পাকিস্তানিরা এ বিচার করতে পারবেন না, তারা মুক্ত হবেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচনে কী পরিমাণ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবেন, সামরিক শাসকরা বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না সে বিষয়টিও পরিষ্কার করে চিত্রিত করেন বঙ্গবন্ধু। নির্বাচনের ফলাফল লৌকিক বঙ্গবন্ধুর অলৌকিক বক্তব্যকে শতভাগ সিদ্ধ করে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের এ বাংলায় যে দুটি আসন তিনি পাবেন না এবং সেখানে কোন কোন প্রার্থী বিজয়ী হবেন তাদের নামসহ সেদিন তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বাস্তবে সেটিই ঘটেছিল। পাকিস্তানিরা যে ক্ষমতা হস্তান্তর বাঙালির কাছে করবেন না এই আশঙ্কা থেকেই তিনি নির্বাচনের আগেই ব্রিটেন সফরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী শক্তি এতই জাদুকরী ছিল যে, রাজনীতির অন্য মতের বিশ্বাসী অনেক নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতেন এই আতঙ্কে যে, বঙ্গবন্ধুর সামনে পড়লে নিজ দলের আদর্শ ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর দলে ভিড়ে যেতে হবে। ৬৬’র ছয় দফা পরবর্তী ৭০ পর্যন্ত চার বছর সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির বাইরে যে সব নেতার ভিন্ন আদর্শের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ছিল এবং যারা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে সমর্থন করেননি এ চার বছর সময়ের মধ্যে দৃশ্যত তাদের জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান দল ছিল ভাসানী সমর্থিত পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট দল। মস্কো ভিত্তিক রাজনৈতিক চেতনার অংশটুকু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে নিজেদেরকে কোনোরকমে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন পূর্ব অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শ্রোততরঙ্গের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার শক্তি কারো ছিল না। ভাসানী সমর্থিত পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা তদানীন্তন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিজেদেরকে অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক অস্তিত্ব অনুভব করলেও বঙ্গবন্ধু স্রোতের ঢেউ উতরে একাকী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মতো সাহসই করে উঠতে পারেননি। অত্যন্ত লজ্জার পরিণতি বিবেচনায় নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন তারা। ৬৬ থেকে ৭০ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জ্যোতির্ময় তরঙ্গের মার্গীয় বিচরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, সে আলোর প্রতিসরণে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির বাইরে থেকে যারা নিজেদেরকে আলোকিত নেতা মনে করতেন, তাদের চোখে দৃশ্যমান বঙ্গবন্ধুকে বিমূর্ত দৈবিক বঙ্গবন্ধু মনে হওয়ায় তাদের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ ঝাপসা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার বিপরীতে কোনো উত্তম বিকল্প ভাবনার অবকাশ ছিল না মোটেও। সর্বাগ্রে সে প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি নির্বাচন-উত্তর ফলাফলে।
পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৪ জন- সর্বমোট জাতীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। যার মধ্যে ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হওয়ায় জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে ৩০০ আসনের মোট ২৮৮টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে উভয় ক্ষেত্রেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক সেনাদের মনস্তত্ত্বের ঔদার্যের সীমাবদ্ধতা বঙ্গবন্ধু খুব ভালভাবেই জানতেন। নির্বাচনে যা ইচ্ছে তাই পরাজিত হওয়ার কারণ; তাদেরকে আরো বেশি ঈর্ষান্বিত করবে। বাঙালি কিংবা বাংলা ভাষাভাষী নেতার কাছে তারা পাকিস্তানে দায়িত্বভার অর্পণ করবেন না। সেটির উপলব্ধি বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন বলে, প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনোন মনোনিবেশ না করে, পূর্বানুমিত দৃঢ়তায় ভর করে মুক্তিযুদ্ধের পথেই হাঁটার গতি বাড়াতে থাকেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টির মুবাশির হাসানকে পাঠিয়ে সেনাবাহিনী অফিসারদের অগোচরে, বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে এবং নিজেকে রাষ্ট্রপতি করবেন এই মর্মে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্ররোচনা প্রস্তাব দিলেও ইনফেরিয়র কমপ্লেক্সেটি থেকে তিনি নিজেই তা মানতে না পেরে, আসন্ন সরকার গঠনকে বানচাল করার জন্য একই সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।
ক্ষমতা হস্তান্তর না করার তালবাহানা শুরু করলেন সামরিক শাসক গোষ্ঠী। ইয়াহিয়া খান ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা করলেন মার্চের ৩ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন করবেন। বেশ খানিকটা বিলম্ব শেষে ১ মার্চ তারিখে অধিবেশনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা প্রস্তুত হয়ে ছিলেন, যথারীতি বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালনের ঘোষণা দিলেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ববাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু। ৬ মার্চের বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করলে, সমগ্র বাঙালি জাতি তাদের দৈব আস্থার প্রতীক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। অতপর ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সমাবেশে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে, মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক কৌশল বর্ণনা করে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটিই বিশেষ অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মন্ত্রপাঠ।
এ ভাষণের প্রতিটি শব্দ, বাক্যের গাঁথুনি, শব্দ উচ্চারণে গুরুত্ব প্রদান, পুণঃউচ্চারণ, কৌশলী শব্দ চয়ন, বক্তব্যের যথার্থতা আর দেহের প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনের ভঙ্গিমা সবকিছু মিলিয়ে খুব স্পষ্ট করেই বলা যুক্তিসঙ্গত যে, কোনো দৈব মেসেঞ্জার বঙ্গবন্ধুর চেতনায় ভর করে এমন একটি ঐতিহাসিক নাটকের ডায়ালগ নিখুঁতভাবে মঞ্চস্থ করালেন, উপস্থিত লাখো জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শ্রবণ করে সে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, প্রতিজ্ঞাচিত্তে কোনো প্রার্থনালয় থেকে অবিচল আত্মত্যাগের প্রশান্তি অনুভবে, যুদ্ধের ময়দানে অংশগ্রহণের নিমিত্তে রেসকোর্স থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। লৌকিকতা ছাড়িয়ে উচ্চমার্গীয় বক্তব্য বিবেচনায় দেরি করে হলেও বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।
একদিকে পাকিস্তানিদের ধর্মকেন্দ্রিক মনস্তত্ত্ব অন্যদিকে ভারতকেন্দ্রিক বাংলা ভাষাভাষী বুদ্ধিজীবিদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত মনোভাব কে অত্যন্ত নিখুঁত ব্যবচ্ছেদ করে তিনি নিজস্ব ধারার জাতীয়তাবাদের ছায়াতলে সকল ধর্মবর্নের মানুষকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে দিয়ে বিশ্বদরবারে বঙ্গবন্ধু আজও রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের অনন্য গবেষক হিসেবে সমাদৃত।
লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

মন্তব্য করুন