জৌলুস হারিয়ে ধ্বংসের পথে সাতক্ষীরার টালি শিল্প

মো. হোসেন আলী, সাতক্ষীরা
  প্রকাশিত : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:৩৭| আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:৪২
অ- অ+

২০০২ সালে প্রথম ইতালিতে রপ্তানি শুরু হয় সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা সদরের মুরারিকাটিতে তৈরি মাটির টালি। দেশের বড় বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এসব কারখানা থেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে মাটির টালি সংগ্রহ করতো। বাংলাদেশে তৈরি এই টালি ইতালিতে জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ধীরে ধীরে ইউরোপ, আমেরিকা, অট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি শুরু হয়। এক সময় সাতক্ষীরার এই টালিপল্লী ছিল শ্রমিকমুখর।

শ্রমিকদের হাসি-কান্না-স্বপ্নের টালি রপ্তানিতে এক সময় আসতো শত কোটি বৈদেশিক মুদ্রা। সাতক্ষীরাসহ আশপাশের জেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ছিল এই খাতে। বর্তমানে ভালো নেই টালি শিল্পের মালিক ও শ্রমিকরা। জৌলুস হারিয়ে ধ্বংসের পথে সম্ভাবনাময় এই টালি শিল্প।

সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না পাওয়া ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়াসহ নানাবিধ সংকটের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভবনাময় এ শিল্প পৌঁছে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক কারখানা। এতে কর্মসস্থান হারিয়েছে হাজারও মানুষ।

কলারোয়ার টালি কারখানা মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের দিকে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে টালির চাহিদা কমে যায়, এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারখানা মালিকরা। সে সময় বাধ্য হয়ে অসাধু বিশেষজ্ঞদের খপ্পরে পড়ে কয়েক কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারখানা মালিকরা। পরবর্তীতে সে টাকা উদ্ধার করতে পারেনি কেউ। এরপর ধীরে ধীরে কারখানাগুলো বন্ধ হতে থাকে।

প্রতিষ্ঠান মালিকদের দাবি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অন্যান্য সুবিধা না পেলে অচিরেই বিলুপ্তি হয়ে যাবে টালি শিল্প। এতে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন প্রতিষ্ঠান মালিকরা।

সাতক্ষীরা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ও টালি ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় বছরের ব্যবধানে ৪১টি কারখানার মধ্যে বন্ধ হয়েছে অর্ধেকেরও বেশি। ২৯টি কারখানা বন্ধ হয়ে এখন নাম মাত্র চলছে ১২টি কারখানা। বর্তমানে চালু থাকা ১২টি কারখানা থেকে বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকার টালি বিদেশের রপ্তানি হচ্ছে।

বংশপরম্পরায় রেখে যাওয়া পেশা পরিবর্তন করতে না পেরে লোকসানের পরও টালি কারখানায় কাজ করে যাচ্ছেন শ্রমিক নৃত্য নাথ।

তিনি বলেন, বছরের অর্ধেক সময় কারখানায় কাজ হয়। বৃষ্টির সময়সহ বেশ কয়েক মাস কাজ বন্ধ থাকে। মাত্র ৩০০ টাকা মজুরিতে সারাদিন শ্রম দিতে হয়। বংশপরম্পরায় রেখে যাওয়া পেশা পরিবর্তন করতে পারি না, এতে লোকসান হলেও এ কাজ করে যেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রথমদিকে আশপাশে অনেক কারখানা ছিল সেখানে আমার মত অনেক শ্রমিক কাজ করতো। সেই সময়টাতে ব্যবসায়ী, শ্রমিক সহকারখানা মালিকরা বেশ লাভজনকভাবে ব্যবসা করেছে। কিন্তু এই ব্যবসায় এখন লোকসানের মুখে। এখানকার কারখানায় নান্দনিক ডিজাইনের ১০-১২ প্রকারের টালি উৎপাদন করা হয়। এসব টালির মধ্যে ফেক্স অ্যাঙ্গুলার টালি, হেড ড্রাগুলার, স্কাটিং, স্টেম্প, স্কয়ার, রুপ, ব্রিকস ও ফ্লোর টালি উল্লেখযোগ্য।

কলারোয়ার মুরারিকাটি পালপাড়ার দীপা টালি কারখানার মালিক বাদল চন্দ্র পাল বলেন, ২০০০ সালের দিকে এখানে টালি নির্মাণ শুরু হয়। ২০০২ সালের দিকে ইতালীয় ব্যবসায়ী রাফায়েল আলদো অসেন বাংলাদেশে। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে নারায়নগঞ্জে টালি তৈরির কাজ শুরু করেন রাফায়েল। কিন্তু ওই এলাকা টালি তৈরির উপযুক্ত না হওয়ায় তিনি তার দেশে ফিরে যান। রাফায়েল ফিরে গেলেও কোম্পানির ম্যানেজার রুহুল আমিন দেশের বিভিন্ন স্থানে পোড়া মাটির টালি তৈরির মাটি খুঁজতে থাকেন। কলারোয়ার কুমোর পাড়ায় এসে পেয়ে গেলেন মাটির ঠিকানা। কারার এক্সপোর্ট ইমপোর্ট প্রা. লি. এর মালিক রুহুল আমিন কলারোয়া কুমোরদের পোড়া মাটির টালির সম্ভাবনার পথ দেখান। সেই সূচনা।

তিনি আরও বলেন, শুরুতেই ৫টি কারখানার উৎপাদিত টালি ইতালিতে রপ্তানি হতো। এ কারণে এলাকাকে অনেকেই ইতালিনগর বলে থাকেন। দুই বছর যেতে না যেতেই এখানকার উৎপাদিত টালি নজর কাড়ে জার্মান, দুবাই, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখানকার টালি কারখানার সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ২০১০ সাল পর্যন্ত টালি শিল্পের মালিকদের সুদিন ছিল। প্রতিটি টালি ৩০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এতে করে প্রতি বছর এ শিল্প থেকে ৩০০ কোটিরও অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো। প্রতিষ্ঠান মালিকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অর্থনৈতিক মান্দার প্রভাবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

টালি কারখানা মালিক সমিতির সভাপতি গোষ্ঠ পাল বলেন, এক সময় সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করা গেলেও এখন নানাবিধ সংকটের কারণে এই শিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ অন্যান্য সুবিধা না পেলে বিলুপ্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এই শিল্পের। কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়া কারখানার সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা ও জাহাজে কনটেইনার পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে রপ্তানিমূল্য কমে গেছে। ফলে টালি শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কাঁচামাল সংকটের পাশাপাশি জ্বালানি ও শ্রমিকের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেকে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন রপ্তানি মূল্য এসে দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৫ কোটিতে। আবার কাঠ-কয়লা-মাটিসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়লেও বাড়েনি টালির দাম। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হস্তক্ষেপে পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব বলে জানান তিনি।

কলারোয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, এখানকার অধিকাংশ মানুষ টালি উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছে। এ শিল্প শুরু থেকে খুবই সম্ভাবনাময় ছিল। বাইরের জেলার অনেক ব্যবসায়ী এ খাতে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ায় অসাধু বিশেষজ্ঞদের খপ্পরে কয়েক কোটি টাকা আটকা পড়ে কারখানার মালিকদের। এই নিয়ে কয়েকবার সালিশ করেছি তবে সেটার কোনো সুরাহ হয়নি। কলারোয়ায় তৈরিকৃত দোঁআশ মাটির এই টালি দেশের আর কোথাও তৈরি হয়না না। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে কারখানা মালিকদের সুবিধার ব্যবস্থা করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা উচিত।

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপব্যবস্থাপক গোলাম সাকলাইন বলেন, সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা সদরের মুরারিকাটিতে উৎপাদিত মাটির তৈরি টালি ইতালি, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পচুর চাহিদা রয়েছে। তবে করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে চাহিদা কিছু কমে গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সংকটের কারণে সেখানকার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তাদেরকে ইতোপূর্বে অনেকবার বলা হয়েছে বিসিকের নিবন্ধন নেওয়ার জন্য। নিবন্ধন না নিলে তাদেরকে সরকারি সব সুযোগ সুবিধার দেওয়া সম্ভব হবে না।

তিনি আরও বলেন, এই শিল্পটি শুধু সাতক্ষীরা নয় দেশের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প এটিকে টিকিয়ে রাখতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে ভালো প্রভাব ফেলবে। এই শিল্পের আধুনিকায়নে নতুন করে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এই শিল্পে আসতে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে।

(ঢাকাটাইমস/২৭আগস্ট/এসএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
অবৈধ অস্ত্র, গুলি, বোমা ও গাড়িসহ আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সাত সদস্য গ্রেপ্তার
থানায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সরাসরি-ভিডিওকলে কথা বলবেন ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি
আওয়ামী লীগের বিচার ইস্যুতে মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে যাবে এনডিএম
ইতালিয়ান পার্লামেন্টের একটি কক্ষে ইমিগ্রেশন সমস্যা নিয়ে আলোচনা সভা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা