শীতের আমেজে শুরু খেজুর গাছ কাটা, রসের অপেক্ষায় সাতক্ষীরাবাসী

জাহাঙ্গীর আলম লিটন, সাতক্ষীরা
 | প্রকাশিত : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:০৫

শীতের হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে দেশে। মাঠে মাঠে হেমন্তের আগমনী বার্তা। এরই মাঝেই কাটা পড়েছে আমন ধান। গ্রামে গ্রামে তাই ভোর রাত থেকে শুনা যায় ঢেঁকির শব্দ। মায়েরা চাউলের গুড়া তৈরির কাজ শুরু করেছে।

এ যেন অপেক্ষার পালা সামনে কনকনে শীতে খেজুরের রসের মৌ মৌ গন্ধে কেউ রস পান করবে, আবার কোন বাড়িতে তৈরি হবে, নানান ধরনের পিঠা, পায়েস, ক্ষীর, ইত্যাদি। পরিবারের যেন সবাই অপেক্ষা করে থাকে এই বিশেষ সময়ের জন্য। পাড়া মহল্লায় আত্মীয়দের আগমন চলতেই থাকে।

সকলের প্রিয় এই খেজুরের রস সংগ্রহ করেন যিনি সেই শিউলি তো প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। তাহলে কে বা সংগ্রহ করবে এই খেজুরের রস। ঐতিহ্য কি তাহলে হারিয়ে যাবে। সাতক্ষীরা শহর থেকে বেশ কিছু দূরে বাবুলিয়া শিউলি আব্দুর রহিমের বাস। আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মধ্যে তিনিই একমাত্র শিউলি বা গাছি যিনি শীত আসলে আর ঘরে বসে থাকতে পারেন না। আনন্দে আর ভালোবাসায় ছুটে চলে যান গাছের সাথে মিতালি করতে। সাথে নিয়ে যান গাছি, ডালি, আর ধারালে সব দা।

শিউলি আব্দুর রহিমের বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই তবুও থেমে নেই তিনি, বাবার দোয়া আর নিপুন হাতের কাজের শিক্ষা নিয়ে তিনি ছুটে চলেছেন। সেই ছোটবেলায় গাছ কাটার সময় বাবা তাকে বলেছিলো গাছের সাথে এই বন্ধন তুই শিখে নে তোর ভালো হবে।

সেই পথচলা শুরু হয়েছিলো আর আজ পঞ্চাশ বছর ধরে খুব সুনামের সাথে এই গাছের সাথে তার নিবিড় বন্ধন। গাছ ও যেন চিনতে পারে তার পরম এই বন্ধুকে।

শিউলি আব্দুর রহিম বলেন, এই কাজ করে বিশেষ কোন লাভ হয় না। কিন্তু খুব ভালো লাগে গাছ কাটতে। শীতের সিজন আসলে মানুষের কাছে যেন এক আলাদা গুরুত্ব বেড়ে যায়। মানুষ আমার কাছে আসে রস নিতে। আমার খুব ভালো। প্রকৃতির নিয়ামত সবাই খেতে পারবে এটায় আমার সুখ। গাছ কাটার সময়ে বাচ্চারা আমার পিছনে ছুটে চলে চোমর (খেজুর গাছের বিশেষ মাতি) খাওয়ার জন্য সে যে কি ভালো লাগে।

শিউলি আব্দুর রহিম বলেন গাছ কাটলেই রস পাওয়া যাবে এমন নয়। এখানে অনেক সুন্দর হাতের কাজ রয়েছে। হেমন্তের মাঝামাঝি সময়ে গাছের ডাল কেছে চেঁচে দেওয়া লাগে তার ঠিক দশ থেকে বারো দিনে পরে হিট দিতে হয়। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করে গাছে খিলান লাগাতে হয়। তারপর দুপুরের পর গাছ বিশেষ কায়গায় কেটে ভাড় দিতে হয়। এরপর অপেক্ষার পালা শুরু হয়। ফোটায় ফোটায় রস পড়তে থাকে। জমতে থাকে মাটির ভাড়ের ভোর সকালে মুয়াজ্জিনের আজান দিলেই শিউলিরা আর ঘুমাতে পারে না। সংগ্রহ করতে ছুটে চলে সুমিষ্ট এই রস।

সকালে আর এক নতুন উৎসব বসে রস জ্বালানোকে কেন্দ্র করে। রস যত জ্বালানো হয় ততই নতুন এক পাগল করা গন্ধ পাড়াময় মৌ মৌ করতে থাকে। পাড়ার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা চামচ নিয়ে এই গুড় খেতে আসে সেটা ভালো লাগার নতুন মাত্রা যুক্ত করে।

বিলুপ্ত প্রায় শিউলি আর খেজুরের গাছনিয়ে তরুণ শিক্ষক পল্লব কুমার বলেন, ইতিহাস ঐতিহ্যের এই খেজুর গাছ আর শিউলি বিলুপ্ত হচ্ছে আধুনিকতার এই করাল গ্রাসে পড়েই। শিউলি কমে যাওয়ায় মানুষ গাছে কেটে নিজেদের প্রয়োজন মিটাচ্ছে। গাছ কাটা কৌশল আর কষ্টকর হওয়ায় নতুন করে আসতে চাইছে না এই প্রজন্মের ছেলেরা। এই পেশায় লাভ কম হয় বলেও নতুন করে আর কেউ এটা শিখতে চায় না। সরকারি উদ্যোগ আর পৃষ্টপোষকতা পেলে এই পেশা আর ঐতিহ্যের খেজুরের রস ও গুড়ের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উপকেন্দ্র সাতক্ষীরার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. বাবুল আকতার বলেন, খেজুর গাছের এই শিল্প আমাদের কৃষির একটি অপরিহার্য অংশ। খেজুর, তালের রস ও গুড় বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। সরকারের পৃষ্টপোষকতা এবং কৃষির সকল দপ্তরের সমন্বয়ে একত্রে কাজের মাধ্যমেই উদ্যোগ গ্রহণ করলে এবং এই গাছি বা শিউলিদের ট্রেনিং ও আধুনিক উপকরণ দিয়ে সহায়তা করলে এই শিল্প বিলুপ্তির হাত থেকে যেমন বাঁচবে তেমন এই শিল্পই হতে পারে বাংলাদেশের এক অনন্য সম্ভাবনা।

খেজুর গাছ প্রকৃতির জন্য যেমন উপকারি ঠিক তেমনি ভাবে এটা মানুষেল দৈনন্দিন জীবনে খুবই প্রয়োজনীয়। আধুনিক সভ্যতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া এই খেজুর গাছ কাটিয়ে এক সময় ঘরের আড়া তৈরি করা হতো। এই গাছের পাতা মায়ের উৎকৃষ্ট জ্বালানিতে ব্যবহার করা হতো। একই সাথে খেজুর গাছের পাতা দিয়ে তৈরি করা হতো খুব সুন্দর চাটায় বা পাটি। আগেকার দিনে এই পাটিতে বসেই মানুষ ভাত খেতো, ছেলেমেয়েরা সকালে মিষ্টিরোদে এই পাটিতে বসেই লেখাপড়া করত। ধান শুকানো, আমসত্ব দেওয়ার জন্য এই চাটাই খুব বেশি ব্যবহার করত মায়েরা।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাংলাদেশের অনেক সংস্কৃতি আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখনো যে শিল্পগুলো বিলুপ্ত হতে হতে উকি মারছে সময়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এই শিল্পগুলো আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে এমনটায় প্রত্যাশা করেন বিশেজ্ঞরা।

(ঢাকা টাইমস/১৬নভেম্বর/এসএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :