‘ভোট আসে যায়, আমগো কী’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ। সামনে থাকছে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের সরকার গঠন। এবার তুলনামূলকভাবে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া অনেকের ভাষ্য, ভোটে তাদের আগ্রহ নেই, ভোটকেন্দ্রেও যাননি।
সারা দেশে ভোটার উপস্থিতি অনেক কমে আসায় ভোট নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলমান। এবারের ভোটে সাধারণ মানুষের কী ভূমিকা ছিল, ভোট নিয়ে এখনও কী ভাবছেন তারা- এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে সরেজমিনে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা টাইমস। ভোটারদের একটি বড় অংশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। আবার অনেকেই নাগরিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তবে ভোটের উৎসবমুখর পরিবেশ না থাকায় বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ করেছেন সবাই।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে একটি চায়ের দোকান আছে ৫০ বছর বয়সী নাজমা আক্তারের। তার সঙ্গে গল্প হয় চা খেতে খেতে। ভোটের বিষয়ে বলেন, ‘ভোট দিতে গেলেও যা, না গেলেও তা। খামাখা কেন যামু? ভোট আসে যায়, আমগো কী?’
এই বাসস্ট্যান্ডেই দেখা হয় ২৪ বছর বয়সী মেহেদী হকের সঙ্গে। প্রতিবেদককে জানালেন, প্রথম ভোটার হয়েছেন ২০১৯ সালে। সে হিসেবে এবারই প্রথম জাতীয় নির্বাচনের ভোটার ছিলেন তিনি। তবে ভোট ও রাজনীতির কোনো সুষ্ঠু পরিবেশ দেখছেন না। তার কাছেও এই ভোট দেওয়া না দেওয়া একই বিষয়। ভোট দেওয়ার কোনো আগ্রহ না পাওয়ায় ভোট বর্জন করেছিলেন তিনি। মেহেদী বলেন, ‘ভোট না দিতে চাওয়াও আমার নাগরিক অধিকার।’
নোয়াখালী অঞ্চলের ভোটার ৪১ বছর বয়সী গিয়াসুল আজম (ছদ্ম নাম) রাজধানীতে সেলস অ্যান্ড মার্কেটিংয়ে কাজ করেন। রবিবার ভোট দিতে বাড়ি গেছেন কি না জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমার পছন্দের কোনো প্রার্থী ছিলেন না। যারে ভোট দিব তিনি ভালো কাজ করলে যেমন ভালো লাগে, আবার খারাপ কাজ করলে সেই দায়ও আমার।’
নিজেকে দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করে এই বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, দেশের এই পরিস্থিতিতে ‘না ভোট’ থাকলে তিনি এটাই বেছে নিতেন।
আরেকজন বেসরকারি চাকরিজীবী ভোটার সাদেক আলী বলেন, ‘ভোট দিতে যাই নাই, কারণ ২০১৪ সালেও ভোট দিতে পারি নাই, ১৮ সালেও পারি নাই। এবারও আলাদা কিছু হইবো মনে হয় নাই। তাই কষ্ট কইরা এলাকায় যাই নাই।’
২০১৪ সালের অভিজ্ঞতা কী- জানতে চাইলে সাদেক আলী বলেন, ‘ভোট দিতে গিয়ে শুনি ভোট হয়ে গেছে, ২০১৮ সালেও একই কথা ছিল।’
মোহাম্মদপুর এলাকার ভোটার কর্মজীবী সালমা আক্তার বলেন, ‘মনে করছি ভোট দিতে যাওয়ার দরকার নাই, ইচ্ছা হয়নি।’ এই কথা বলার সময় কিছুটা অস্বস্তিতে ভোগেন তিনি। ভাবভঙ্গিতে বোঝান আশেপাশে সবার সামনে এসব কথা বলতে চান না।
তবে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দিয়েছেন নিত্যপণ্য ব্যবসায়ী জসিমউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আগের মতো ভালো না লাগলেও ভোট দিতে গেছি। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই ঢাকায় ভোটার। আমার ছেলেটা কখনো ভোট কীভাবে হয় তা দেখেনি, তারে দেখাইতে নিয়ে গেলাম। আগে আমরা ভোটের যে চিত্র দেখেছিলাম, ছেলেকে তো সেরকম দৃশ্য দেখাইতে পারি নাই।’
প্রায় ৬০ বছর বয়সী সলিমুল্লাহ সবসময় নৌকার সমর্থক ছিলেন, এবারও তাই। ভোটের পরিস্থিতি কেমন দেখলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগের মতো প্রতিযোগিতা থাকলে ভাল্লাগতো।’
এমন বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই নির্বাচন আংশিক ত্রুটিপূর্ণ।‘ কারণ হিসেবে তিনি তুলে ধরেছেন সরকারবিরোধী ভূমিকায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নেয়া এবং ইনক্লুশান (অন্তর্ভূক্তি) শতভাগ নিশ্চিত করতে না পারা। একইসঙ্গে সব শ্রেণি-পেশা ও দল-মত নির্বিশেষে ভোটের উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি না হওয়া।
তবে মোটাদাগে এই নির্বাচন ‘শান্তিপূর্ণ’ হয়েছে বলেও জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। এক্ষেত্রে তিনি মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাদারিত্বের ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোও নির্বাচনের দিন প্রতিহত করার চেষ্টা করেনি।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ জানিপপের পক্ষ থেকে কুমিল্লা ১, ৬, ৭ আসন, মুন্সীগঞ্জ ৩ এবং নারায়ণগঞ্জ ৩ আসনে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
দেশের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬২ জন নির্বাচিত হওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলেও মত দিয়েছেন এই নির্বাচনি পর্যবেক্ষক। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিয়ে কীভাবে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে- এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. কলিমুল্লাহ জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত আগেও রয়েছে। অনেক কম আসন নিশ্চিত হওয়ায় জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও জানান জানিপপের চেয়ারম্যান।
নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের বিষয়ে ইতিহাস তুলে ধরে ড. কলিমুল্লাহ বলেন, ‘১৯৭৩ এ প্রথম যে জাতীয় সংসদ গঠিত হয় সেখানে লিডার অব হাউজ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বিরোধী নেতা ছিলেন আতাউর রহমান খান। বিরোধী দলে অনেক অল্পসংখ্যক এমপি ছিলেন, তাদের মধ্যে অধিকাংশই স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত ছিলেন। লিজেন্ডারি পার্লামেন্টিরিয়ান (কিংবদন্তী সংসদ সদস্য) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মরহুম সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ- তারা ৭৩ সালের সংসদে স্বতন্ত্র হিসেবে ছিলেন। তখন যেহেতু কোনো অসুবিধা হয়নি, এখন হবে কেন?’
এবার নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের জোট গঠন করার সম্ভাবনা দেখেন কি না- এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে শুনেছি স্বতন্ত্র এমপি নিক্সন চৌধুরী এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেন।’
মজিবুর রহমান ওরফে নিক্সন চৌধুরী ফরিদপুর-৪ আসনে এর আগেও দুইবারের সংসদ সদস্য এবং যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। এবার এই আসনে নৌকার মনোনয়ন আওয়ামী লীগের কাজী জাফর উল্যাহকে দেওয়া হয়। তবে ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে টানা তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হন নিক্সন।
বিজয়ী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সদস্য হয়ে কীভাবে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবেন এই প্রশ্নের জবাবে ‘গণচীনের’ উদাহরণ টানেন ড. কলিমুল্লাহ। বিএনপির পুনরায় নির্বাচনের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সকল রাজনৈতিক দল যদি একমত হয়, কোনো কারণে পার্লামেন্ট যদি ভেঙে যায় তাহলে সেই সুযোগ তৈরি হতে পারে, নতুবা নয়।’
এদিকে ভোট প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বাতিল এবং পুনঃনির্বাচনের দাবিতে দুদিনের গণসংযোগ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
অন্যদিকে নির্বাচনের শেষ দিকে এসে জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের অনেক প্রার্থী ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দাবি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এছাড়া অনিয়মের অভিযোগে স্থগিত ময়মনসিংহ-৩ আসনে আগামী ১৩ জানুয়ারি পুনরায় ভোটের প্রস্তুতি নিয়েছে ইসি। যদিও ভোটগ্রহণ বাতিল হয়েছে মোট ১০টি আসনের ২২টি কেন্দ্রে।
(ঢাকাটাইমস/০৮জানুয়ারি/এসআরপি/কেএম)

মন্তব্য করুন