কারাভোগী বিএনপি নেতারা নানা রোগে কাবু

সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া হাজারো নেতাকর্মী আছেন কারাগারে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জামিনে মুক্ত হচ্ছেন অনেকেই। কারামুক্ত হলেও নেতারা বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। বয়স এবং বিভিন্ন রোগের কারণে অনেকেই মুক্ত হওয়ার পর স্বাভাবিক চলাচল করতে পারছেন না। আবার অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন হাসপাতালে।
অনেকটা সুস্থ অবস্থায় গত বছরের ৩ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সত্তুরোর্ধ্ব বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে। গ্রেপ্তারের সাড়ে তিন মাস পর হঠাৎ কারাগারে অচেতন হয়ে পড়েন যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকার সাবেক এই এমপি। দ্রুত তাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে স্থানান্তর করা হয় আইসিইউতে। ওই সময় উচ্চ আদালতে তার জামিনের আবেদন করে পরিবার। অসুস্থতার বিবেচনায় তাকে জামিন দেন আদালত। হাসপাতালের আইসিইউ থেকেই মুক্তি পান তিনি।
সালাহউদ্দিন আহমেদের মতো কারামুক্ত হওয়া এক ডজন বিএনপি নেতা শারীরিক নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। অনেকে রয়েছেন মানসিক ট্রমায়। তারা জানিয়েছেন, কারাগারে বিএনপি নেতাদের যে ভবনে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে বের হতে দেওয়া হতো না। আবদ্ধ রুমে অনেকটা শুয়ে-বসে দিন কাটাতে হয়েছে তাদের। এতে মানসিক চাপে পড়ে অনেকে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। নিম্নমানের খাবার ও দূষিত পানির কারণে অনেকের কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। চোখে ও দাঁতের সমস্যায় আক্রান্ত হন অনেকে।
বিএনপির তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারাদেশে দলটির ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত তিন মাসে কারাগারে চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন দলটির ১৩ জন নেতা। ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর জুনিয়র ও মধ্যম সারির অনেক বিএনপি নেতা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও এক ডজন সিনিয়র নেতাসহ অনেকেই এখনো কারাগারে রয়েছেন। কারাগারে থাকা অনেকে অসুস্থতায় ভুগছেন। যারা কারামুক্ত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন।
এদিকে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, কারাবিধি অনুযায়ী বিএনপি নেতাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তারের ১৫ দিন পর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তার পুত্র ও ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনকেও। সাড়ে পাঁচ মাস কারাভোগের পর গত ২৯ জানুয়ারি মুক্তি পান তিনি।
রবিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, আব্বা ও আমাকে একই কারাগারে নেওয়া হলেও আমাদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। সাবেক সংসদ সদস্য হওয়া উচ্চ আদালত তাকে ডিভিশন দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ডিভিশন দেয়নি। ২১ নভেম্বর ভোরে কারাগারে তিনি বুকের ব্যথায় অচেতন হয়ে পড়েন। মৃত ভেবে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে হাসপাতালে পাঠায়। হাসপাতালে তাকে রাখা হয় প্রিজন সেলে। সেখানে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন, কিন্তু চিকিৎসকরা সেটা আমাদের পরিবারের সদস্যদের জানাননি। একপর্যায়ে তার লিভার ও কিডনি আক্রান্ত হয়। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে ২৫ দিন চিকিৎসা নেন। এরপর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে দেড় মাসের মতো চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন বাসায় অবস্থান করলেও শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছেন। বেশিক্ষণ হাঁটতে ও বসে থাকতে পারেন না। হাতে পায়ে পানি চলে এসেছে। দীর্ঘদিন ক্যানোলা লাগিয়ে রাখা হাতে ইনফেকশন হয়ে যায়। এছাড়া হার্ট ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন। রবিন আরও জানান, দীর্ঘদিন কারাগারে আবদ্ধ রুমে থাকায় তিনি নিজেও শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন। শিগগিরই চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যাবেন।
২ নভেম্বর গ্রেপ্তারের পর ৩ মাস ৬ দিন কারাভোগ করেন ঢাকা উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক। ১২ মামলায় জামিনের পর ৯ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান সাফজয়ী জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক এই অধিনায়ক। কারাগারে থাকা অবস্থায় দুদফায় ১১ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয় আমিনুলকে। দ্বিতীয় দফা রিমান্ড চলাকালে তার কিডনিতে পাথর ধরা পড়ে।
আমিনুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, কারাগার থেকে মুক্তির পর কিডনির পরীক্ষা করিয়েছি। এখনো রিপোর্ট হাতে পাইনি। পরীক্ষার রিপোর্ট পেলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেব। আপাতত ব্যথানাশক ওষুধ খাচ্ছি। মাঝে-মধ্যে ঠাণ্ডা জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছি।
কারাজীবনের বর্ণনা দিয়ে জাতীয় দলের সাবেক এই গোলকিপার বলেন, কাশিমপুর কারাগারের ভবনের চারতলার কক্ষ থেকে নিচে নামতে দেওয়া হয়নি। শুধু আদালতে যাওয়ার দিন সকালে বের করা হতো, বিকালে ফের রুমে নেওয়া হতো। বাকি ৩ মাস ৬ দিন একরুমে কাটিয়েছি। হাটাচলার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
গত ২২ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনূস মৃধা। সাড়ে তিন মাস কারাভোগের পর ২২ জানুয়ারি মুক্তি পান তিনি। মুক্তির পর বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন ৬৭ বছর বয়সি এই বিএনপি নেতা।
ইউনূস মৃধা ঢাকা টাইমসকে বলেন, কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে যে তিনটি ভবনে বিএনপি নেতাদের রাখা হয়েছিল সেই ভবন থেকে কাউকে বের হতে দেওয়া হতো না। আমাদের আবদ্ধ রুমে থাকতে হয়েছে। হাঁটাচলা না করতে পারায় ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। এছাড়া ১৫ দিন পরপর পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হতো। আমার পরিবার থেকে দেওয়া ওষুধ শেষ হয়ে গেলে বাইরে থেকে ওষুধ আনার অনুমতি দেওয়া হতো না। তিনি আরও বলেন, কারাগারের খাবার ও পানি এত নিম্নমানের তা মুখেই নেয়া যায় না। নিম্নমানের খাবার খাওয়ার কারণে আমার ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, পাইলস ও প্রেশারের সমস্যা দেখা দেয়। এ রোগগুলো আমার আগে ছিল না। এছাড়া কিডনিতে ও চোখে নতুন করে সমস্যা দেখা দেয়। মুক্তির পরপরই রাজধানীর একটি হাসপাতালে চোখের অপারেশন করিয়েছি। ইবনেসিনায় মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়েছি। বারাকাহ হাসপাতালে কিডনির ডাক্তার দেখিয়েছি। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ৭৬টি মামলা দায়ের হয়েছে। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ির পর অসুস্থ শরীর নিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
মহাসমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনায় গত বছরের ৪ নভেম্বর রাজধানীর বাড্ডা এলাকার আত্মীয়ের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সকে। তিন মাস কারাভোগের পর গত শনিবার জামিনে মুক্তি পান তিনি। মুক্তির পর মানসিক ট্রমায় ভুগছেন এই বিএনপি নেতা। কারাগারে থাকা অবস্থায় তার শারীরিক নানা জটিলতা দেখা দেয়। মুক্তির পরদিনই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি।
এমরান সালেহ প্রিন্স ঢাকা টাইমসকে বলেন, কারাগারে মানসিক নানা চাপের মধ্যে ছিলাম। তিন মাস আবদ্ধ রুমে থাকায় হাইপারটেনশন বেড়ে গেছে। এখনো মানসিক ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সামান্য হাঁটতেই হাফিয়ে যাচ্ছি। ক্লান্তি ভর করেছে। রবিবার সারাদিন বিভিন্ন ব্লাড টেস্ট করিয়েছি। সন্ধ্যায় রিপোর্ট নিয়ে গিয়েছি ডাক্তারের কাছে। এছাড়া দাঁতের সমস্যায় ভুগছি। আপাতত কয়েকদিন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলবো।
এদিকে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান। অসুস্থতার বিবেচনায় আদালত তাকে জামিন দেয়। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে মুক্তি পেলেও হার্ট, ভাল্ব ও প্রোস্টেটের অসুস্থতায় ভুগছেন তিনি। নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে। ক্যানসার আক্রান্ত বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে তার অসুস্থতা বেড়ে যায়। দেড় মাস পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এখন রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ওদিকে কারাবন্দি ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু কয়েকদফা কারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া কারাগারে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী দুই সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান ঢালী, হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ বেশ কয়েকজন নেতা বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকা টাইমসকে বলেন, আটককৃত নেতাকর্মীদের কারাগারের ভেতর প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। সেখানে কোনো এক্সপার্ট ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞ নেই। নেই কোনো ল্যাব। অনেকে জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সুচিকিৎসা পাননি। এরজন্য জেলখানায় অসুস্থ হয়ে পড়া নেতাকর্মীরা এখন নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন।
(ঢাকাটাইমস/১৫ফেব্রুয়ারি/এআর)

মন্তব্য করুন