গণহত্যার দায় ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ

ফকির ইলিয়াস
 | প্রকাশিত : ২৭ মার্চ ২০২৪, ১৩:১১

বাংলাদেশ আরেকটি স্বাধীনতা দিবস পালন করলো। ৫৩ বছর আগে এমন দিনেই ঘাতকচক্র ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ বাঙালি জাতির উপর। সে এক নৃশংসতম ঘটনা! একাত্তরে যে শিশু তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-পরিজন হারিয়েছিল ওই শিশুর বয়স এখন ৫৩ বছর! সে কি তার পিতা হত্যার বিচার পেয়েছে? না, পায়নি। বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে প্রায়ই দাবি উঠেছে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বস্বীকৃতির। কিন্তু তা এখনও কার্যকর করা যায়নি। এই দাবিটি আবারও উঠেছে।

পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংগঠিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ব্রিটিশ সংসদে একটি প্রস্তাব উপস্থাপনের জন্য চেষ্টা করবেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ বিষয়ক বাণিজ্য দূত টম হান্ট। গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক আয়োজিত ’রিমেমবারিং দি বাংলাদেশ জেনোসাইড ১৯৭১: দি রোড টু ইন্টারন্যাশনাল রিকগনিশন’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ বিষয়ক বাণিজ্য দূত টম হান্ট বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে যে নৃশংসতা হয়েছিল সেটি ভুলে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়।

১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান স্যার পিটার শোর সংসদে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে নৃশংসতার নিন্দা জানিয়ে একটি মোশন এনেছিলেন। এর পরপরই একশন বাংলাদেশ আরেকটি পূর্ব বাংলায় জেনোসাইড বন্ধ এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতি বিষয়ক একটি মোশন আনে- যেটি ২৩৩জন বিভিন্ন দলের সংসদ সদস্য সমর্থন করেছিলেন বলে জানান রাষ্ট্রদূত সাইদা মুনা তাসনিম।

একই বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান রো খান্না এবং স্টিভ শ্যাবটের আনা রেজুলেশনের প্রশংসা করে রাষ্ট্রদূত ব্রিটিশ সংসদে এর পুনরাবৃত্তির আহ্বান জানান। কনসারভেটিভ ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়ার প্যাট্রন লর্ড রামি রেঞ্জার জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সমর্থন ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশের মানুষ চান, এই দাবি পূরণ করা হোক। কিন্তু এর বিরোধিতাকারীও আছে। এরা কারা?

এটি একটি দীর্ঘ প্রশ্ন। উত্তর অনেকে জানেন। কেউ জেনেও না-জানার ভান করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিপক্ষ কে? বিষয়টি নিয়ে প্রজন্মকে ভাবা দরকার। এই দেশে অনেককিছুই হতে পারতো। হয়নি। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। এমন অশান্তি এই জাতি চায়নি। তারপরও আজ বাংলাদেশ জ্বলছে। চারদিকে হায়েনার ফণা। হ্যাঁ, দায় নিয়েই চলেছে বাঙালি জাতি। কালের আবর্তনে হারিয়ে গেছে অনেক কথা। অনেক স্মৃতি। তারপর বেঈমানি করেছে রাজনীতিকরা। কথা দিয়েও, কথা রাখেনি তারা।

বাংলাদেশে একটি পক্ষ এখনও পাকিস্তানি তমদ্দুনের দোসর। প্রশ্নটি হচ্ছে এই দোসর কারা? এদের পরিচয় কী? প্রশ্ন আসতেই পারে, বিএনপিপ্রধান জিয়া কিংবা খালেদা জিয়া কি তাদের পরিচয় জানতেন না? তারাই তো শাহ আজিজ, যাদু মিয়া, আলীম আল রাজী, নিজামী, মুজাহিদ- এদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। কেন বানিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা এভাবেই হয়েছিল তার হাতে।

আমরা পত্রপত্রিকায় পড়েছি- বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় গিয়ে অনেক ডকুমেন্টস নষ্ট করেছে। তারা তা করবে এটা অজানা ছিল না। কিন্তু যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তাদের পশ্চাৎপদতা ছিল চোখে পড়ার মতো। চৌধুরী মইনুদ্দীন এখন লন্ডনের বাসিন্দা। আশরাফুজ্জামান খান নিউইয়র্কের বাসিন্দা। এই দুজনই বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম সহযোগী। এদের নাম আছে ঘাতক-দালালদের তালিকায়। এরা পালিয়ে এসেছিল। এদের বিচারের রায় হয়েছে। আর রায়ের পর এরা বলেছে- তাদের কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।

বাংলাদেশের রাজাকাররা তাদের ক্ষমতা পরীক্ষা অতীতে করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। তা নতুন কিছু নয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে তাদের। সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রাজনীতিকদের তারা কাজে লাগিয়েছে নিজেদের প্রয়োজনে। আবার ছুড়ে দিয়েছে। ব্যবহার করে ছুড়ে দেওয়াই মওদুদীপন্থিদের হীনকর্ম। যারা ব্যবহৃত হয়েছেন তারা কেউই লজ্জিত হননি। আর সেরা রাজাকার, আল-বদর কমান্ডাররা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এটাই হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে মহান স্বাধীনতার প্রকৃত বাস্তবতা! বর্তমান সরকার প্রজন্মের কাছে ওয়াদা করেছিল এদের বিচার করবে। সেই ধারাবাহিকতায় এদের বিচারকাজ হয়েছে। এখনও চলমান বলা হলেও- দৃশ্যমান নয়। এদের টুঁটি চেপে অনেক আগেই ধরা যেত। কিন্তু রাজনীতিকরা তা ধরেননি। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১১ হাজারের মতো। অথচ জনসংখ্যা দেশে সতেরো কোটির ওপরে। এদের তো ‘রা‘ করার কোনো উপায় থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তারপরও দেশের মহান স্বাধীনতার তিন দশক পার হওয়ার আগেই তারা মন্ত্রিত্ব পেয়েছে- যারা সরাসরি একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর আগে জিয়াউর রহমান এই পথ দেখিয়েছিলেন। ভাগবাটোয়ারা করে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং টিকে থাকার জন্যও প্রতিযোগিতার ফল এমনটিই হয়।

ভাবতে অবাক লাগে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, ডিসকাশন গ্রুপে রাজাকারপন্থি কিছু-কিছু উত্তরসূরি প্রশ্ন তোলে, ‘একাত্তরে আদৌ ৩০ লাখ বাঙালি শহিদ হয়েছিলেন কি না।’ ধৃষ্টতা আর কাকে বলে! তারা বলে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা চাননি, পশ্চিমাদের সঙ্গে সমঝোতা করে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিলেন। এমন নানা উদ্ভট তথ্যও হাজির করে মাঝে মাঝে। এসবের উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের রাজাকারী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা। প্রজন্মের ব্রেনওয়াশ করা। এরা কোনো ইতিহাস, কোনো ডকুমেন্টারি মানতে চায় না। বিদেশের বিভিন্ন আর্কাইভে রাখা তথ্য-তত্ত্বগুলো বিশ্বাস করতে চায় না। না বুঝতে চাইলে তাদের বুঝাবে কে? কিন্তু কথা হচ্ছে আজকে যারা সত্যের অন্বেষণের রাজনীতি উপহার দিতে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের জন্য কাজ করছেন, তাদের অভিপ্রায় কী এ ব্যাপারে? খুনিদের বিচার না করে কি সে লেভেল বাংলাদেশে তৈরি হবে? এই দাবি এদেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই করে আসছেন।

১৯৯২ সালে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম এদেশের মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন। তার সেই ডাকের পথ ধরেই আজো চলছে এই আলোকিত প্রজন্ম। আমরা দেখছি ইউরোপ-আমেরিকায় এখনো নাৎসিবাদের গন্ধ পাওয়া গেলে সেখানে কামান দাগাবার চেষ্টা করে সরকার পক্ষ। এটি হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এ প্রশ্নে আপস করলে রাষ্ট্র বিপন্ন হতে পারে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। আর পারি না বলেই বিষয়টি জিইয়ে রেখে শুধুই রাষ্ট্রের ক্ষতি করা হবে। একটা বিষয় আমরা লক্ষ করছি। যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলেছে কিংবা হয়েছে- তখন বিশ্বের কোনো কোনো সংস্থা ‘মানবাধিকার’-এর কথা বলছে। আমার প্রশ্ন হলো একাত্তরে যখন বাংলাদেশে গণহত্যা হয়, তখন তাদের এই দাবি কোথায় ছিল?

আমাদের মনে আছে- যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার নাভি পিল্লাই। একই অবস্থা হয়েছে সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের বেলায়ও।

কারা একাত্তরে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য পাকিদের শলাপরামর্শ দিয়েছিল, তা কিছুই লুকানো নয়। এসব বিষয়ে সে সময়ের দলিলপত্র দেশে-বিদেশে এখনো সংরক্ষিত আছে। কথা হচ্ছে, নানা রাজনৈতিক ছলচাতুরী সুবিধাভোগের ফন্দিফিকিরের নামে রাজনীতিকরা বেহুঁশ থাকায় ঘাতক দালালদের বিচার করা যায়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে- এদের বিচার কোনোদিনই করা যাবে না। কিংবা কেউ করতে পারবে না। ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলতেই বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন, শঙ্কার কথা তোলা হয়েছে শুরু থেকেই। এর নেপথ্য কারণ কী? যারা যুদ্ধ চলাকালে সুস্থ মস্তিষ্কে গণহত্যা করে কিংবা মদত জোগায়, তারাই যুদ্ধাপরাধী। এসব যুদ্ধাপরাধীর অবস্থান একাত্তরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল তীব্রভাবে। তাই এই ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটিকেই বিচার চেয়ে বাদী হতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যুগে যুগে যেমনটি বিচার চাওয়া হয়েছে। এবং রাষ্ট্র সেসব বিচারের ব্যবস্থাও করেছে। একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে সত্যের পক্ষে মানুষ যেকোনো সময়, যে কোনো দেশে দাঁড়াতে পারে।

আরও একটি কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বলতে চাই। আর তা হচ্ছে, এ দেশে যদি কোনোভাবে রাজাকারদের পক্ষপাত করা হয়, তবে কারো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই শুভ হবে না। কারণ রাজাকাররা এমন এক অশুভ শক্তি, যারা সময় সুযোগ পেলেই ছোবল দেয়। অতীতে দিয়েছে। ভবিষ্যতেও দেবে। দেশের আপামর জনগণ জানেন এরা কত জঘন্য মানসিকতাসম্পন্ন। তাই এদের বিচার আজ রাষ্ট্রীয় দাবি। বর্তমান সরকার এদের বিচার না করলে কালের আবর্তে এই দেশ আবারো ওয়ান-ইলেভেন পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরে যেতে পারে। রাষ্ট্রের বুকে সৃষ্ট ক্ষত আরো বিশাল আকার ধারণ করতে পারে। জাতিকে এদের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন বলেই জাতির প্রত্যাশা। একইসাথে বলতে চাই, রাজাকারের পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি প্রকাশ করা হোক।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র লেগেই আছে! কে কোন দিকে চাল দিচ্ছে তা বুঝা ও বলা মুশকিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্জন পূর্ণতা না পেলে স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না। দেশে চরম ক্রান্তিকাল চলছে। লুটেরারা বিদেশে টাকা পাচার করছে। অপচিকিৎসায় মানুষ জর্জরিত। আমাদের সড়কের পাশে পড়ে আছে ধর্ষিতা বালিকার লাশ। সামাজিক নিরাপত্তা নেই শিক্ষাঙ্গনে। এসব নিয়ে তো মানুষ স্বাধীন থাকতে পারে না। এসবের বিহিত করতে না পারলে প্রজন্ম দাঁড়াবে কোথায়?

ফকির ইলিয়াস: কলাম লেখক, কবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :