ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আ.লীগে বিশৃঙ্খলা, নানা প্রশ্ন

দলের শৃঙ্খলা নীতিতে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে থাকলেও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখায় তার উল্টো চিত্র। বিশৃঙ্খলা যেন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সাংগঠনিক শাখায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠেছে, কতদিন এভাবে চলবে, কতদিনে শৃঙ্খলা আসবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগে।
অসামাজিক কার্যকলাপ, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, কমিটি বাণিজ্য, দলের পদপদবি ব্যবহার করে চাঁদাবাজির অভিযোগে দপ্তর সম্পাদকসহ ঢাকা দক্ষিণের অন্তত ছয় নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন সংগঠনটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা ঢাকা টাইমসকে বলেন, দক্ষিণ আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ, বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করেছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে যেমন মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা আছে অন্য নেতাদের মধ্যেও তেমন আছে। ফলে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত। এজন্য বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। মহানগরের বেশিরভাগ নেতা আওয়ামী লীগের চেয়ে কে কার লোক সেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, যা দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়িয়েছে।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা ও শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে বেশি জড়িত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ।
গত আট মাসে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার অভিযোগে আওয়ামী লীগ তাকে দুইবার শোকজ ও একবার বহিষ্কার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে বহিষ্কারের পর তিনি আবার স্বপদে ফিরে আসেন। আর স্বপদে ফিরে এসেই তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সদস্য সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলীর অশালীন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তার পদ রক্ষায় ১০ লাখ টাকা দাবি করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অডিও ছড়িয়ে পড়লে গত ২৯ এপ্রিল দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। মে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে তাকে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছে।
গত ২২ এপ্রিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সদস্য সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলীর নগ্ন ভিডিও ভাইরাল হয়। যোগাযোগমাধ্যমে এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যা নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে আওয়ামী লীগ। পরে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরেই দপ্তর সম্পাদক রিয়াজের চাঁদা চাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তারপর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।
আরও পড়ুন>ঢাকা দক্ষিণের আ.লীগ নেতা রিয়াজকে ফের শোকজ
অভিযোগ আছে, সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলীর কাছে দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করলে তা দিতে দেরি হয়। এজন্য অন্য একজন কাউন্সিলরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে দ্রুত চামেলীকে অব্যাহতি দিতে সুপারিশ করেন তিনি।
এর আট মাস আগে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের (নারী শিক্ষা মন্দির) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে বিদ্যালয়টির সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর কয়েকদিন পর সেই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে রিয়াজকে বহিষ্কার করে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি কেন তাকে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না- এই মর্মে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে জবাব (শোকজ) দিতে বলা হয়। কিন্তু তার কয়েক মাস না পেরোতেই রিয়াজকে আবার স্বপদে বহাল করা হয়। তাকে স্বপদে বহাল করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা।
মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ঢাকা টাইমসকে জানান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে চলেন দক্ষিণের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ। তাই দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতির কথা ছাড়া কারো কথা তেমন তোয়াক্কা করেন না। দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের পাত্তা দেন না তিনি।
২০২১ সালে নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাসকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাসকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কারের আদেশ দিলেও তার কয়েক মাস পরে তা তুলে নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় গত বছরের ৭ জুন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদারকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তার প্রত্যাহার আদেশ তুলে নেওয়া হয়নি।
২০২২ সালের শেষের দিকে দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এফ এম শরীফুল ইসলাম শরীফের একটি অশ্লীল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ফেসবুকে নিন্দার ঝড় উঠে। তারপর প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দলে ও দলের বাইরে এ নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা চলে। এরপর তাকে গত বছরের ৪ জানুয়ারি অব্যাহতি দেওয়া হয় মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ থেকে। কিন্তু প্রায় দেড় বছর কেটে গেলেও শরীফের অব্যাহতি আদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি।
এছাড়া মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকেও বিভিন্ন কারণে ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও তা তুলে নেওয়া হয়নি।
বিশৃঙ্খলা থেকে বাদ যাননি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরও। বেফাঁস মন্তব্য করার কারণে শোকজ করা হয় তাকে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবু আহমেদ মন্নাফী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করেছি। কিন্তু কিছু লোক তারপরও বিশৃঙ্খলা করে যাচ্ছে। আমাদের দপ্তর সম্পাদকের টাকার লোভ বেশি। তিনি ১০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন সেটা আমরা শুনছি। তার জন্য ব্যবস্থাও নিয়েছি। আসলে কথায় আছে, কম পানির মাছ বেশি পানিতে গেলে লাফালাফি বেশি করে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ঢাকা টাইমসকে বলেন, দপ্তর সম্পাদক রিয়াজের টাকা চাওয়ার একটা রেকর্ডের কথা শুনছি। এজন্য আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/০১মে/জেএ/ইএস)

মন্তব্য করুন