‘মনে হয় আত্মহত্যা করি, তাতে যদি বেঁচে যাই!’

‘মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করি। তাতে হয়তো এই কষ্টের জীবন থেকে বেঁচে যেতে পারি। কারণ এভাবে একটা মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি- এটাতো পাপ! কেননা সৃষ্টিকর্তা তো বলেছেনই, আমার উপর ভরসা রাখো। আমিই সব মুশকিলের আসান করি। আর তুমি কিছু দিনের জন্য ধৈর্য ধরতে পারলে না। তাই তো সেই আশায় এখনো অপেক্ষা করে যাচ্ছি, যদি তিনি আমাকে ভালো করে দেন।’
কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নের ভবদীয়া গ্রামের হতদরিদ্র মো. মোকসেদ মোল্লার ছেলে মো. তারেক। যিনি জন্মের পর থেকেই যুদ্ধ করছেন নানা রোগের সঙ্গে। এখনো জানা নেই- আরও কতকালের জন্য তাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে শরীরের সঙ্গে। না কি জীবনের কাছে হার মেনে অকালেই চলে যেতে হবে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে!
তারেক বলেন, ‘কোনো মতে দর্জির কাজ করে জীবনটা চলছিল। কিন্তু পরপর দুইটা অপারেশেন করতে গিয়ে অনেকটা ভেঙে পড়েছি। আরও একটা অপারেশন করাতে হবে। ডাক্তার বলেছেন, এই অপারেশনটা হলে আমাকে আর রক্ত নিতে হবে না। কিন্তু এটা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ভয়ে আছি। কারণ এর আগে একবার সঠিক চিকিৎসার অভাবে ইনফেকশন হয়ে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়েছে।’
জানা যায়, ২৫ বছরের এই যুবক জন্ম থেকেই ভুগছেন রক্তস্বল্পতাসহ নানা জটিল রোগে৷ হেরেডিটরি স্ফেরোসাইটোসিস নামে এক বিরল রোগে আক্রান্ত তার মা। ২৫ বছর ধরে একই রোগে আক্রান্ত তারেকও। তার বৃদ্ধ মায়ের শরীরে রক্ত দিতে হয় নিয়ম করে। নিয়মিত রক্ত নিতে হয় তারেককেও। রোগটি থেকে পুরোপুরি নিস্তার পেতে করাতে হবে অপারেশন।
জন্ম থেকে অসুস্থ তারেক ইতোমধ্যে দুটি অপারেশনের মুখোমুখি হয়েছেন তারেক। আরও একটি অপারেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে। তবে অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল এই অপারেশন নিয়ে চিন্তিত অসহায় এই যুবক। কারণ এ বিষয়ে সহযোগিতা করার মতো তার কোনো আপনজন নেই।
চিকিৎসকদের মতে, হেরেডিটরি স্ফেরোসাইটোসিস একটি বংশগত রক্তের ব্যাধি। লোহিত রক্ত কণিকার সমস্যার কারণে এটি ঘটে। এর ফলে রক্তের অক্সিজেন বহনের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়াসহ শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতে অজ্ঞান হওয়া, চেতনা হ্রাস পাওয়া এবং তৃষ্ণা বৃদ্ধির মতো লক্ষণগুলো বাড়তে থাকে। এর ফলে অস্ত্রোপচারেরও (অপারেশন) প্রয়োজন হতে পারে। সাধারণত মা-বাবা থেকেই এই রোগগুলো এসে থাকে। তবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনের হার বাড়ানো যায়।
তারেক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই রোগে ভুগছি। মাসের পর মাস চিকিৎসা নিচ্ছি। শিগগিরই অপারেশন করার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার। নইলে সমস্যা আরও জটিল হবে। কিন্তু এর জন্য অনেক টাকার দরকার। সরকারি হাসপাতাল থেকে করাতে গেলেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। কারণ সেখানে পরিচিত লোকজন ছাড়া ভালো সেবা পাওয়া কঠিন। আগের দুই অপারেশন থেকে আমার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে।’
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারেকদের পরিবার দক্ষিণ ভবদীয়া (নতুন পাড়া) এলাকায় এসেছেন বছর কয়েক আগে। এর আগে ছিলেন একই ইউনিয়নের নয়নসুখ গ্রামে। পদ্মা নদীতে বসতভিটা বিলিন হয়ে যাওয়ার পর নিঃস্ব পরিবারটি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বৃদ্ধ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান তারেকের চিকিৎসার ভারে পরিবারটি আরও অসহায় হয়ে পড়েছে।’
তারেকের ষাটোর্ধ বয়সি মা মোছা. তারা বানু বলেন, ‘আমি অসুখে মানুষ। তারেককে নিয়ে আমাগের বাইচে থাহা। কিন্তু ওর অসুখের কারণে তাও শ্যাষ। আমাগেরে বয়স অইচে। কহন বাঁচি কহন মরি জানি না। কিন্তু আমার বাজানডার অসুখ দেহে আরও কষ্ট লাগে। ওপরওয়ালা আমাগের সাথে এমন করতেছে! আমার ছেলেডার জন্যি আপনাগের কাছে সাহায্যর আবদার করছি।’
তারেক বলেন, ‘আমার এই অপারেশনটার জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কোনো জনপ্রতিনিধি বা কারও কোনো সহযোগিতা পাইনি। বাধ্য হয়ে পরিবার ঋণ করে আমার চিকিৎসা করাচ্ছে। কারণ অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন আর কাজ করতে পারি না। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি আমার চিকিৎসায় একটু সহায়তার হাত বাড়াতেন, তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকতাম।’
আকুতির সুরে তারেক আরও বলেন, ‘আমি বাঁচতে চাই। সবার সঙ্গে মিশতে চাই। বৃদ্ধ বাবা-মাকে সেবা করতে চাই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তারাই আজ আমাকে সেবা করছেন। এটা একটা সন্তানের কাছে কত বেদনার- সেটা বলে বোঝানো যাবে না।’
অসহায় তারেকের জন্য সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছেন এলাকাবাসীও। শিগগিরই তারেক সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক বাবা-মায়ের বুকে- এমনটাই প্রত্যাশা তার প্রিয়জনদের।
(ঢাকাটাইমস/০৩মে/এলএম/এজে)

মন্তব্য করুন