রক্তস্বল্পতা রোগ থ্যালাসেমিয়া, মুক্তির উপায় প্রতিরোধ

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ মে ২০২৪, ১৪:৫৬ | প্রকাশিত : ০৮ মে ২০২৪, ১৪:৫৩

মারণব্যাধি থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত একটি রোগ। থ্যালাসেমিয়া সৃষ্টিকারী জিন মিউটেশনের সর্বপ্রথম উদ্ভব ঘটেছিল ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে আংশিক সুরক্ষা হিসেবে। তাই বিশ্বের যে অঞ্চলগুলোতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি সেখানে থ্যালাসেমিয়া সক্রিয়। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপ এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো।

থ্যালাসেমিয়া একটি গ্রিক শব্দ। থ্যালাসা কথার অর্থ সমুদ্র। আনেমিয়া কথার অর্থ রক্তাপ্লতা। কথিত আছে, গ্রিসের কোনও এক সমুদ্রের ধারে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ১৯২৫ সালে আমেরিকার টমাস কুলি ও পারোল লি এই রোগটি চিহ্নিত করেন। এটি রক্তের বংশগত অসুখ। প্রধানত জিনগত সমস্যা থেকেই এই রোগ হয়। বংশানুক্রমিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ হলে রক্ত স্বাভাবিক ভাবে তৈরি হয় না। হিমোগ্লোবিনে ত্রুটি থেকে যায়। লোহিত রক্ত কণিকার আয়তন ছোট হয়। তাই রোগাক্রান্তকে অন্য রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করতে হয়।

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি নারী-পুরুষ নিজের অজান্তে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মায়। মরণব্যাধি থ্যালাসেমিয়া বেশির ভাগ রোগী রক্তস্বল্পতায় ভোগে। প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহ পরপর তাদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওষুধ এবং অন্যের কাছ থেকে রক্ত নিতে হয়। এটি আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। সত্যিকার অর্থে থ্যালাসেমিয়া রোগের স্থায়ী চিকিৎসা নেই। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা হচ্ছে ‘ব্যোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন’ ও জীন থ্যারাপি। তবে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অথচ একটু সতর্কতা অবলম্বন করা হলেই এই মর্মান্তিক পরিণতি এড়ানো যাবে। তাই রোগটি প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি আমাদের সবার দায়িত্ব।

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত প্রতিটি রোগীর বংশানুক্রমিক যোগসূত্র থাকে তাদের পূর্বপুরুষের সঙ্গে। তাই জিনগত সমস্যা হওয়ায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রোগ থেকে দূরে থাকার কোনো প্রশ্ন নেই। তবে যত দ্রুত সম্ভব শনাক্ত করে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এতে সম্পূর্ণভাবে রোগমুক্তি না মিললেও জটিলতাগুলো অনেকাংশে কমানো যায়। তাই চলুন, থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ, লক্ষণ, ও নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

লোহিত রক্তকণিকার প্রোটিন অণু হিমোগ্লোবিন সারা শরীরে অক্সিজেন বহন করে। থ্যালাসেমিয়া এমন একটি বংশানুক্রমিক ব্যাধি, যার ফলে এই হিমোগ্লোবিনে অসঙ্গতি দেখা দেয়। ফলে লোহিত রক্তকণিকা অত্যধিক মাত্রায় ধ্বংস হয়ে শরীরকে রক্তাল্পতার দিকে ঠেলে দেয়।

মা-বাবার মধ্যে যেকোনো একজনের থ্যালাসেমিয়া হলে সন্তানও এই রোগে আক্রান্ত হয়। এটি মূলত জেনেটিক মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তনের কারণে ঘটে। এই পরিবর্তনটি ঘটে কোষের ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড) তে, যা হিমোগ্লোবিনকে প্রভাবিত করে।

হিমোগ্লোবিন অণুগুলো আলফা এবং বিটা নামক চেইন দিয়ে তৈরি। থ্যালাসেমিয়ায় এই আলফা বা বিটা চেইনের উৎপাদন কমে যায়। আর এ কারণে থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই ধরনের- আলফা-থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা-থ্যালাসেমিয়া।

আলফা-থ্যালাসেমিয়ায় রোগের তীব্রতা নির্ভর করে পিতামাতার কাছ থেকে প্রাপ্ত পরিবর্তিত জিন সংখ্যার উপর। যত বেশি পরিবর্তিত জিন, থ্যালাসেমিয়া তত গুরুতর। অন্যদিকে, বিটা-থ্যালাসেমিয়ায় হিমোগ্লোবিন অণুর কোন অংশ প্রভাবিত হয়েছে তার উপর নির্ভর করে রোগের মাত্রা কম-বেশি হয়।

আলফা-থ্যালাসেমিয়া

এই রোগে হিমোগ্লোবিনের আলফা চেইনকে প্রভাবিত করতে সর্বোচ্চ চারটি পরিবর্তিত জিন অংশ নেয়। মা ও বাবার প্রত্যেকের কাছ থেকে দুটি করে। শুধু একটি জিন পেয়ে থাকলে আক্রান্তের দেহে রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। কিন্তু এরপরেও আক্রান্তের দেহ থেকে পরবর্তীতে তার সন্তানদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে।

দুটি জিনের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ হালকা হয়। আর এই অবস্থাতেই রোগীকে আলফা-থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বলা হয়। তিনটি জিন প্রাপ্ত হলে উপসর্গ মাঝারি থেকে গুরুতর হয়। বংশানুক্রমিকভাবে চারটি জিন পাওয়াটা দুর্লভ। এই ক্ষেত্রে শিশুরা প্রায়ই জন্মের পরেই মারা যায় বা আজীবন ট্রান্সফিউশন থেরাপির প্রয়োজন হয়।

বিটা-থ্যালাসেমিয়া

রোগের এই সংস্করণে হিমোগ্লোবিন বিটা চেইনকে প্রভাবিত করতে দুটি পরিবর্তিত জিন অংশ নেয়। সন্তান মা ও বাবার প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে জিন পায়। একটি জিন পেলে রোগের হালকা লক্ষণ দৃশ্যমান হয়। এই অবস্থাকে থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বিটা-থ্যালাসেমিয়া বলা হয়।

দুটি জিন প্রাপ্ত হওয়া মানেই রোগ মাঝারি থেকে গুরুতর পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। এই অবস্থাকে থ্যালাসেমিয়া মেজর বা কুলি অ্যানিমিয়া বলা হয়। দুটি বিটা হিমোগ্লোবিন জিন নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা সাধারণত জন্মের সময় সুস্থ থাকে। কিন্তু প্রথম দুই বছরের মধ্যেই লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ

উপসর্গহীনতা বা হালকা উপসর্গ: একদম প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো উপসর্গই পরিলক্ষিত হয় না। সর্বোচ্চ হালকা রক্তাল্পতার কারণে মৃদু ক্লান্তি বোধ হতে পারে।

হালকা থেকে মাঝারি উপসর্গ: লক্ষণ হালকা রক্তাল্পতা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে মাঝারি পর্যায়ের দিকে এগোতে থাকে। এ সময় দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। বয়ঃসন্ধিকাল আসতে বিলম্ব হয়। অস্টিওপরোসিস বা হাড়ের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। তলপেটের অভ্যন্তরের প্লীহা নামক অঙ্গটি অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে যায়। এই প্লীহা পেটের ভেতরে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভূমিকা পালন করে।

গুরুতর লক্ষণ

রক্তাল্পতা এ ক্ষেত্রে মাঝারি থেকে প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় যে উপসর্গগুলো দেখা দেয় তা হলো: আহারে রুচি কমে যাওয়া, ত্বক ফ্যাকাসে বা হলুদ হওয়া, প্রস্রাব গাঢ় রঙের হওয়া, মুখের হাড়ের গঠন অস্বাভাবিক হওয়া

থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়

স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য জরুরি ভাবে বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষা করতে পারেন। এই টেস্টগুলো হলো:

কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট: এর মাধ্যমে হিমোগ্লোবিন এবং লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ এবং আকার সম্বন্ধে জানা যায়। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের সাধারণত স্বাভাবিকের চেয়ে কম স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকা এবং কম হিমোগ্লোবিন থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের লোহিত রক্তকণিকা স্বাভাবিক মাত্রায় থাকতে পারে।

রেটিকুলোসাইট কাউন্ট: এটি মূলত তরুণ লোহিত রক্ত কোষের একটি পরিমাপ। এর মাধ্যমে জানা যায়, অস্থি মজ্জা যথেষ্ট পরিমাণে লোহিত রক্ত কোষ তৈরি করছে কি-না। এছাড়া আয়রনের টেস্টের মাধ্যমে রক্তশূন্যতার কারণ যাচাই করা হয়। বিটা-থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস। আর আলফা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে জেনেটিক পরীক্ষা করা হয়।

চিকিৎসার সম্ভাব্য উপায়

ব্লাড ট্রান্সফিউশান: এই চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যকর লোহিত রক্তকণিকা এবং হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা পুনরুদ্ধার। এর জন্য শিরাতে লোহিত রক্ত কোষ প্রবেশ করানো হয়। মাঝারি বা গুরুতর থ্যালাসেমিয়াতে প্রতি চার মাসে এবং বিটা-থ্যালাসেমিয়া মেজরে প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহে একবার করে ট্রান্সফিউশন দেয়া হয়। হিমোগ্লোবিন এইচ রোগ বা বিটা থ্যালাসেমিয়া ইন্টারমিডিয়ার জন্য মাঝে মাঝে ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন হতে পারে।

আয়রন চিলেশন: এই চিকিৎসার মাধ্যমে শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন অপসারণ করা হয়। ব্লাড ট্রান্সফিউশানের একটি ঝামেলা হলো, এর ফলে আয়রন বেড়ে যেতে পারে। আর অত্যধিক আয়রন বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতির কারণ হতে পারে। ঘন ঘন ট্রান্সফিউশন দেয়া হলে তার সাথে আয়রন চিলেশন থেরাপিও দেওয়া হয়।

ফলিক অ্যাসিডের সাপ্লিমেন্ট্স: শরীরে সুস্থ রক্তকণিকা তৈরির জন্য ডাক্তার এই প্রতিষেধকগুলো গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

বোন ম্যারো অ্যান্ড স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্ট: এই জটিল চিকিৎসায় একজন উপযুক্ত দাতার কাছ থেকে অস্থি মজ্জা এবং স্টেম সেল রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। উপযুক্ত মানে গ্রহীতার মত দাতার কোষের পৃষ্ঠে থাকতে হবে একই ধরনের প্রোটিন, যাকে হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (এইচএলএ) বলা হয়। চিকিৎসা চলাকালীন গ্রহীতার রক্তপ্রবাহে দাতার অস্থি মজ্জা স্টেম সেল প্রবেশ করানো হয়। প্রতিস্থাপিত কোষগুলো এক মাসের মধ্যে নতুন ও সুস্থ রক্তকণিকা তৈরি করতে শুরু করে।

শুধুমাত্র বংশানুক্রমিকভাবে যোগসূত্র থাকা ব্যক্তিরাই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হন। অর্থাৎ, আক্রান্ত শিশু এই ব্যাধি নিয়েই জন্ম নেয়। ফলশ্রুতিতে, জিনগত এই ব্যাধি থেকে দূরে থাকার কোনো প্রশ্ন থাকে না। তবে এর জটিলতাগুলো প্রতিরোধ করার জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

স্বামী বা স্ত্রী যে কারো এই ব্যাধি থাকলে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে জেনেটিক্স কাউন্সিলরের শরণাপন্ন হতে হবে। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে মা ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে নিয়ে আসাটাই এখানে মূল উদ্দেশ্য।

বিয়ের মাধ্যমে এ রোগটি বিস্তার লাভ করে। যেমন ধরুন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন অথবা উভয়ই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে জিনগত কারণে সে দম্পতির সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এজন্য চিকিৎসকরা বলছেন, বিবাহযোগ্য ছেলে-মেয়েরা তাদের বিয়ের আগে এই রোগের জিনবাহক কি না তা জেনে নেয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে থ্যালাসেমিয়া রোগটি সম্পর্কে ধারণা না থাকলেই তারা বিপত্তিতে পড়েন।

থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা করে রোগটি সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা ও তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

(ঢাকাটাইমস/৮ মে/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :