ভাষা কি পণ্য?

ইমরুল কায়েস
| আপডেট : ১১ মে ২০২৪, ১৭:৪৫ | প্রকাশিত : ১১ মে ২০২৪, ১৬:২৯

Book অর্থে বই কেন? ফুল, পাখি, নদী, মেঘও তো হতে পারত (!) পাশ্চাত্য ব্যাকরণবিদরা মনে করেন শব্দের এই অর্থভেদ স্বেচ্ছাচারী এবং কাকতালীয়। তাদের দৃষ্টিতে ভাষা সৃষ্টির সময় থেকেই মানুষ তার চারপাশের পরিবেশের সাথে অভিযোজনের প্রয়োজনে সমগ্র সত্তাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে নামকরণ করেছে। আর সেই নামকরণ হয়েছে বিশেষ বিশেষ ধ্বনিপুঞ্জ বা বর্ণসমষ্টিতে অর্থ গেঁথে দেওয়ার মাধ্যমে। আর সেই শব্দগুলোই বিবর্তনের ভিতর দিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। তারপর বাক্যের নিয়ম তৈরি করে সেই অর্থবোধক শব্দ দিয়ে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করছি। বিষয়টি পরিস্ফুট করতে দার্শনিক পার্সের ‘চিহ্ন’/‘Sign’ এর ধারণাটি উল্লেখযোগ্য। ধরা যাক, কোনো অঞ্চলে একটি পক্ষযুক্ত দ্বিপদ প্রাণী দেখা গেল। প্রাণীটিকে এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। তাহলে এই প্রাণীটির আমরা কী নামকরণ করবো। পার্সের সংজ্ঞায় পাখি শব্দটি একটি চিহ্ন। যেখানে পক্ষযুক্ত দ্বিপদ প্রাণীটি Signifier এবং পাখি শব্দটি Signified। প্রকৃতপক্ষে পাখি শব্দটি একটি পক্ষযুক্ত দ্বিপদ প্রাণীর চিহ্ন যা অনেকটাই অনুমাননির্ভর অভ্যাস দিয়ে গঠিত।

কিন্তু প্রাচীন ভাষা দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরো অন্তর্ভেদী। তাঁরা লক্ষ করেছিলেন প্রতিটি বর্ণ বা বর্ণময়ধ্বনি কোনো না কোনো অর্থ বহন করে। আর সেই বর্ণ দিয়ে যে শব্দ তৈরি হয় তা সেই বর্ণের অর্থেরই প্রতিনিধি। অর্থাৎ শব্দের বর্ণ বা ধ্বনিপুঞ্জে আছে শব্দের অর্থের রহস্য। কোনো শব্দের জন্মই অলৌকিক নয়। যেকোনো শব্দই সুনির্দিষ্ট নিয়মে উৎপন্ন। কোনো বর্ণে বা বর্ণসমষ্টিতে মনগড়া অর্থ চাপিয়ে দেওয়া মানেই ভাষার ব্যাভিচার। যেকোনো শব্দই খামখেয়ালিপূর্ণ চিহ্নিতকরণে তৈরি হতে পারে না। বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক নোম চমস্কিও তাঁর কালজয়ী ভাষাতত্ত্বে বাক্যগঠনের সর্বজনীন সূত্রাবলি আলোচনা করলেও শব্দ সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে তাঁর সজ্ঞানসূত্র এক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিন্তু ভারতীয় মনীষী ভর্তৃহরি, আর্যভট্ট, যাস্ক, পাণিনির হাত ধরে সুকুমার রায়ের বর্ণতত্ত্বের ভিতর দিয়ে কলিম খাঁন এবং রবি চক্রবর্তীর ভাষাতত্ত্বে সে রহস্য পুরোপুরি মীমাংসিত হয়েছে। আমরা যদি এখন এই বর্ণ বা বর্ণধ্বনির অর্থগুলোকে যেকোনো শব্দে প্রয়োগ করি তবে সেই শব্দের ভিতর এবং বাহিরের সানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ পেয়ে যাবো- যেখানে সকল ভাবনা এই বর্ণসমষ্টির বর্ণে বর্ণে রাঙিয়ে উঠে। বর্ণগুলো যেন ব্যষ্টিক এবং সামষ্টিক চেতনার একটা বিংব্যাং।

অ-অস্তিত্বন, আ-অস্তিত্ব, ই-সক্রিয়ণ, ঈ-সক্রিয়, উ-উত্তীর্ণন, ঊ-উত্তীর্ণ, ঋ-আবর্ত্তন, এ-দিশাগ্রস্তন, ঐ-দিশাগ্রস্ত, ও-অস্তিত্বাদিকরণ, ঔ-অস্তিত্বাদিকর, ক-করণ, খ-করণস্থিতি, গ-গমন, ঘ-গমনস্থিতি, ঙ-কারীরহস্য, চ-চয়ন, ছ-চয়নস্থিতি, জ-জনন, ঝ-জননস্থিতি, ঞ-চায়ীররহস্য, ট-টঙ্কারণ, ঠ-টঙ্কারণস্থিতি, ড-ডয়ন, ঢ-ডয়নস্থিতি, ণ-টঙ্কারীর রহস্য, ত-তারণ, থ-তারণস্থিতি, দ-দান, ধ-দানস্থিতি, ন-নাকরণ/অনকরনণ, প-পালন, ফ-পালনস্থিতি, ব-বহন, ভ-বহনস্থিতি, ম-সীমায়ন, য-যাওয়ন, র-রহন/ভক্ষণ/রক্ষণ, ল-লালন-লোপন, শ-শক্তিযোজন , ষ-দিশাগ্রস্ত শক্তি যোজন, স-একরৈখিক শক্তি যোজন, হ-হওয়ন, ড়-ড এর রহস্যরূপ, ঢ়-ঢ এর রহস্যরূপ, য়-যাওনের রহস্যরূপ, ৎ-উল্লস্ফন, ং-বিন্দু, ঃ-বিসর্জন ,ঁঁ-বিন্দু

এই বর্ণগুলোর অর্থ থেকে আমরা গ-বর্ণের অর্থভেদ কিছুটা উন্মোচন করে দেখতে পারি। গ বর্ণটি গমনক্রিয়ার ধারক। তাহলে গামী কে? যে যায়। গণ কী? এক সাথে গমন করেন যারা। গগণ কী? গামী যেখানে গমন করে। গবাক্ষ কী? জানালা, যে পথে আলোকরশ্মি যায়। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে গ বর্ণটি কোনো না কোনোভাবে গতিশীলতার অর্থ বহন করে। এভাবে ভাষার সমগ্র উপাদানই বর্ণের অর্থভেদের সাথে সম্পর্কিত। তাহলে শব্দ সৃষ্টির মর্মভেদ লুকিয়ে রয়েছে বর্ণ বা বর্ণ চিহ্নিত অর্থের ধাতুমুলে। আধুনিক ভাষাপণ্ডিতেরা যেখানে শব্দসৃষ্টিকে বিশৃঙ্খল মনে করেন, সেখানে প্রাচীন ভারতীয় ভাষা আচার্যরা হাজার বছর আগে ইঙ্গিত করেছিলেন শব্দের মর্মার্থ। কিন্তু সে ইঙ্গিত আমাদের বোধের জগতে অধরাই ছিল।

স্বজ্ঞাময় চেতনায় ঋদ্ধ এই দার্শনিকেরা নিরীক্ষণ করেছিলেন- এই বিশ্ব-প্রপঞ্চে কোনোকিছুই স্থির নয়। বরং গতিশীল। একটা ক্রিয়াময় শক্তিই জগতে বিদ্যমান। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে জড়বস্তু নামক স্থির পদার্থের কোনো অস্তিত্ব এখানে নেই। যেকোনো পদার্থকে ভাঙলে কোনো জড়বস্তু খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে শুধু শক্তিময় ইলেকট্রনের আবর্তন। এক শক্তিই যেন নৃত্য করছে চিরদিনের স্পন্দনে। তাই ভাষাতাত্ত্বিকেরা শব্দের উৎসমূলে শুধু ক্রিয়া শক্তিকেই লক্ষ করলেন। এই ক্রিয়াশক্তিই বর্ণময় ধাতু। তাহলে বিশেষ্যপদ কোথা থেকে পেলাম? বিশেষ্যপদগুলো মূলত ক্রিয়াপদ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। ভাষা দার্শনিক যাস্কের নিরুক্তিতে দেখানো হয়েছে বিশেষ্যপদগুলো কীভাবে ক্রিয়াপদ থেকেই উৎসারিত। ভাষা সৃষ্টির প্রাকপর্বে শুধুমাত্র ক্রিয়াপদই ছিল। উদাহরণস্বরূপ তরু কী? তর তর করে যা বেড়ে উঠে তাই তরু। সাদৃশ্যে ইংরেজি Tree শব্দটি তৃ-ধাতুরই উপজাত। যাহোক বিশেষ্যপদ তখনো চিন্তার অতীত। কারণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তখনো কোনো বস্তুকে অধিকার করার মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বিশেষ্যপদ তৈরি হয়েছিল যখন প্রাচীন সমাজে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটার সময়। ব্যবসা মানেই পণ্যের আদান-প্রদান। তাই পণ্যকে চিহ্নিত করার প্রয়োজনে তৈরি হলো বিশেষ্যপদ। পণ্যের মতো বিশেষ্যপদগুলোও স্থির। তাই পণ্য বিনিময় ধারণার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভিতরে কোনো বস্তুকে অধিকার করার মনস্তাত্ত্বিক পর্যায় সূচিত হলো। বিশেষ্যপদ যেমন স্থির তেমনি পণ্যও স্থির হওয়াতে তাকে কুক্ষিগত করে সম্পদ স্তূপীকৃত করার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলো। কারণ জড়সাদৃশ্য স্থির বস্তুকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, আস্বাদন করা যায়, এমনকি প্রয়োজনে সঞ্চিত করেও রাখা যায়। প্রাচীন মানুষগুলো ঠিক এমনি সমাজ বিবর্তনের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একদিন যে মানুষগুলোর শুধুমাত্র ক্রিয়াপদের সাথে পরিচয় ছিল, পণ্যের বাণিজ্যকরণে তারাও চিনে নিলো বিশেষ্যপদের স্বরূপ। আর এই যুগসন্ধিক্ষণেই তৈরি হলো বিশেষ্যপদ। যেন সবকিছুকেই নামাবলীর ভিতর দিয়ে চিহ্নিতকরণ। জীবন জীবিকার ক্রমাগত প্রসারে বিশেষ্যপদগুলো একটা নতুন মাত্রায় সংযোজিত হলো। তখন সেই সমাজই দ্রুত প্রসারিত হতে লাগলো যে সমাজগুলো পণ্য উৎপাদনশীলতায় প্রাগসর ছিল। পণ্যের অধিক উৎপাদনে তৈরি হতে লাগলো মুনাফা। মুনাফার আধিক্যে সমাজ ব্যবস্থার কাঠামোও বদলাতে লাগলো। আর পণ্যের বিকেন্দ্রীকরণে পণ্যের সংজ্ঞাও হলো পরিবর্তিত, রূপান্তরিত। এখন পণ্য বলতে শুধু ভোগ্যপণ্যই নয়, তার সংজ্ঞা প্রসারিত হয়েছে বিমূর্ত তথ্য পর্যন্ত। আর পণ্যের এমন মুক্ত বিচরণ মানুষকে বর্ধিত করছে আরো উন্নত সংস্করণে। তবে পণ্যের ধারণা ভাষাকে যতই প্রবাহিত করুক, ক্রিয়াপদময় বর্ণশাসনই ভাষার মূল চালিকাশক্তি। যে শক্তি মন মগজকে শাসিত করছে প্রবহমান সময়ের সুচেতনায়। তবু একটি প্রশ্ন! ভাষা বিচরণ কি সত্যিই একটি ভাষাগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদনশীলতার সাথে সম্পর্কিত যার ফলে বহু ভাষাই আজ বিলুপ্তির প্রান্তিক অবস্থানে?

ইমরুল কায়েস: কলেজ শিক্ষক, লেখক ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :