আহসান হাবিব রচিত ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’: যাপিত জীবনে মুক্তির আলোর হাতছানি

নাজমিন মর্তুজা
  প্রকাশিত : ২৮ জুন ২০২৪, ১৩:২৫| আপডেট : ২৮ জুন ২০২৪, ১৩:২৯
অ- অ+

জীবন মৃত্যুর মঞ্চের আলো আর উইংসের অন্ধকারের মাঝে যে একফালি প্রেম, তারই ব্যক্ত বা অব্যক্ত ক্ষত নিয়ে লেখক আহসান হাবিব তাঁর প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত আয়নার মতো পাঠকের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন এক অনুপম আখ্যানে। মানুষের জীবনে ক্ষত যখন প্রেমের স্পর্শ পায় তখনই পবিত্রতায় উত্তীর্ণ হয় প্রতিদিনের বেঁচে থাকায়। লেখকের এই আদ্যন্ত কৌতূহলকর টানটান উপন্যাসে মৃতের অনুভূতি-সংলাপ আসলে প্রেমের নতুন নাম। আরও আছে নরখাদক শিকারের গল্প যা নানা অনুষঙ্গে বারবার ফিরে এসেছে। মৃত জগৎ সংসারের গহনে ভালো মানুষ খারাপ মানুষের প্রকাশিত রূপ আর আড়ালকৃত রূপের রুদ্ধশ্বাস ইঁদুর-বেড়াল খেলা মানবিক সম্পর্কের নানান দিক। লেখক ভবসাগরের আলো আর অন্ধকারের কুহক এঁকেছেন মৃতের চোখে। দেখে ফেলেছেন মানুষের ভেতরের লুকোনো অস্ত্র, লুকোনো অসুখগুলো। একে একে জেগে উঠেছে অচেনা সরীসৃপের ফনা। সাহসের সহসা নোঙর ডুবিয়ে রেখে গল্পের নায়িকা নন্দিনী যখন থেকে থেকে মৃতের ঘরে গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে আলো ফেলছে তখনই মৃত আহসানের আত্মা নিস্তব্ধ ভেসে থাকে কল্পনার মিনাবাজারে। লেখক গল্পটা ফেঁদেছেন মরণের ওপারে কল্পলেনের ছোট্ট ঘরে। কিছু কিছু সময়ে মনে হতে পারে অগোছালো নির্মাণের মধ্যে আছে আপন বিস্তৃতি স্পন্দন, একটা পথরেখা। যে পথে গল্পের মূল চরিত্র আহসান আত্ম-আবিষ্কার, আত্ম-নির্মাণে অভিজ্ঞতা ও উদার চেতনায় নিজের মৃতদেহের এনাটমিকাল ডিসেকশনের ভেতরে কী আশ্চর্য অনুভূতিকে জাগিয়ে রেখে দুঃসময়ের অস্থিরতার, কাতরতার আকুতি সহজ শব্দে। গদ্য আখ্যানে গল্প বলার ঢংটা চমৎকার। কথার ভাঁজে ভাঁজে শুনিয়ে যাওয়া দর্শন, উন্মুক্ত পাঠকমন ছাড়া সে সত্যি স্পর্শ করা অসম্ভব। লেখকের চেতনার ভূবনটিকে জটিল এবং বহুমাত্রিক মনে হয়েছে, হয়তো সেই জন্য তার বোঝাপড়া আবছায়া বৃত্তে তত্ত্বের আনাগোনা। যারা কিছুটা অন্য মনস্ক পাঠক, তত্ত্বকথা শুনতে চান না তারা একটু থেমে যাবার স্পেস নিতে পারেন, এছাড়া মনস্ক পাঠক পড়ে বুঝতেও পারেন আবার নাও পারেন। এই উপন্যাসের একটা বেশ স্বাধীন একরোখা বিষয় আছে যেটা একান্তই লেখকের ডিসিপ্লিনের মধ্যে রেখেছেন।

সমাজ সংস্কৃতির মানুষের লোভ স্বার্থপরতার সঙ্গে ছায়াময় প্রেমের নৈরাশ্যের উপস্থিতি চোখে পড়ে। কথায় কথায় লুকপুক প্রেমের অনুভূতি শেকড়হীনতার নেরেটিভ ক্রমাগত কথোপকথনভিত্তিক উপস্থাপনায় নায়ক আহসান নিজেকে দু'ভাগ করে নিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং নায়িকা মানে নন্দিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, ফোন সবকিছুর কথোপকথনের নকশা এঁকেছেন নন্দিনী চরিত্রে। বর্ণনায় উঠে এসেছে উত্তর-আধুনিকতা, কালচার স্টাডিজ মার্ক্সবাদী নারীর চৌকষ সৌন্দর্য ও বুদ্ধিদীপ্ত নারী, যাকে রাজপথ থেকে টেনে ঢুকিয়েছেন রান্নাঘরের খিঁচুড়ির ভোগে। যদিও প্রেমের গভীরে গিয়ে ব্যাখ্যা করেননি। চলমান প্রেমের ফুল বুকে নিয়ে আহসান একদিন টুপ করে মারা গেল। সকালে ঘুম ভাঙল না। একাকী চার কামরায় বাস করা মানুষটা, মৃতদেহে জিইয়ে রাখলেন আত্মা। একে একে দেখা মিললো ভোগবাদী, বাজারসর্বস্ব বিশ্বে পুঁজিই প্রথম ও শেষ কথা। আর প্রেমিকা রয়ে গেল বোকা বসন্তের গল্পের ওয়েটিং রুম অফ হিস্ট্রিতে। বৈষয়িক দলাদলির ব্যাপারটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে উপস্থাপন করলেও ভোগবাদী সমাজের মানবিকতাকে ছাপিয়ে লোভীদের পোট্রেটগুলোর খণ্ডচিত্র তিনি আঁকতে পেরেছেন। নায়কের জীবনবৃত্তান্ত লেখার ছলে একটি অতি সাধারণ ঘরের নানা স্তরের নির্মাণ ও বিনির্মাণের গল্পটা পড়তে সুখপাঠ্য ছিল।

জীবনে যেসব নতুন সুযোগ বা পথের দরকার তার সবটুকুই আপনার কল্পনায় অপেক্ষমান। যা লেখক আহসান হাবীব মানবপ্রকৃতি, লোভ-লালসা, ভয়, যুদ্ধ, আকাক্সক্ষা, যৌনতৃষ্ণা- সবকিছুতে জীবনে মুক্তির আলো নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। জীবনে একটা আলাদা আনন্দের স্বাদ নেবার আশায় লেখক মৃত আহসানের উপড়ে ফেলা চোখে প্রজাপতির ডানা ছুঁয়ে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে এনেছেন। কোনোকিছু অর্জনের উদ্যম বা চেষ্টাই মানুষের বেঁচে থাকাকে সার্থক করে তোলে, হয়তো অর্জন করতে চেয়েছিলেন নন্দিনীকে। তবে লেখক জানেন এই অনন্ত অসীম পরিধির মধ্যে মাত্র কয়েক মূহুর্তের জন্য আমাদের অস্তিত্ব বজায় আছে। সময়! যার দার্শনিক নাম মহাকাল।

১৪৩ পাতার লেখা বইটি বেশ ছিমছাম অলংকরণের প্রশংসা করতেই হবে হাতে নিয়ে। আহসান হাবিব রচিত বইটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ২৪০ টাকা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন- রাজীব দত্ত। বইটি প্রকাশ করেছে- পেন্ডুলাম পাবলিশার্স

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নিজের ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে সাবেক বিচার চাইলেন রাশেদ খান
এসপি পদমর্যাদার ১৪ কর্মকর্তার বদলি
হঠাৎ 'আত্মগোপনে' পালং মডেল থানার পরিদর্শক
ফাইল আটকে রাখায় মাউশির রাজশাহী কার্যালয়ে দুদকের অভিযান
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা