লাল মাংস খেয়ে হজমশক্তি বাড়ানোর স্বাস্থ্যকর উপায়

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৯ জুন ২০২৪, ০৯:০৩
অ- অ+

লাল মাংস বা রেডমিট সারা পৃথিবীতে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশেও লাল মাংস পছন্দ করেনা এমন মানুষ খুব কমই আছে। আয়রন ও প্রোটিনের অন্যতম উৎস হলো লাল মাংস। শরীরের জন্য উপকারী পরিমিত লাল মাংস। গরু, মহিষ, খাসি, ভেড়া প্রভৃতি পশুর মাংসকে রেড মিট বা লাল মাংস বলে। এতে মায়োগ্লোবিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে বলে কাঁচা অবস্থায় টকটকে লাল দেখায়। পুষ্টিগুণের বিচারে লাল মাংস অনেক সমৃদ্ধ। এতে প্রচুর আয়রন, প্রোটিন, ভিটামিন বি, জিংক এবং অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ রয়েছে, যা শরীর গঠনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিনের সমৃদ্ধ উৎস এই লাল মাংস হলেও এগুলোতে সম্পৃক্ত চর্বির (স্যাচুরেটেড ফ্যাট) মাত্রা থাকে বেশি। থাকে প্রচুর খারাপ কোলেস্টেরলও। ফলে বেড়ে যেতে পারে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।

তাছাড়া হঠাৎ করে বেশি পরিমাণে মাংস পাকস্থলীর পরিপাক ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাবে। যেকোনো বয়সের মানুষের হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির জটিলতা ও রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির জটিলতায় যারা ভুগছেন, মাত্রা ছাড়া মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সাবধান হতে হবে।

আমরা অনেকেই যে খাবার খাই তার পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে সচেতন নই। গরু, ছাগল বা মহিষের মাংসের গুণাগুণ জানেন না অনেকে। জানা থাকলে সচেতন হওয়া যায়। অতিভোজনও এড়ানো যায়।

প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ জলীয় অংশ, ১ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ১১৪ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ২২ দশমিক ৬ গ্রাম আমিষ, ২ দশমিক ৬ গ্রাম চর্বি, ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, শূন্য দশমিক ৮ মিলিগ্রাম লোহা, শূন্য দশমিক ১৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১, শূন্য দশমিক শূন্য ৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন-বি-২ এবং ২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে।

মহিষের মাংসে ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ জলীয় অংশ, ১ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ৮৬ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ১৯ দশমিক ৪ গ্রাম আমিষ, ১ দশমিক ৯ গ্রাম চর্বি এবং ৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে।

ছাগলের মাংসে আছে ৭৪ দশমিক ২ শতাংশ জলীয় অংশ, ১ দশমিক ১ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ১১৮ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ২১ দশমিক ৪ গ্রাম আমিষ, ৩ দশমিক ৬ গ্রাম চর্বি এবং ১২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম।

লক্ষ রাখতে হবে, মাংসে যেন কোনো সাদা চর্বি না থাকে। অর্থাৎ মাংসের গায়ে যে সাদা চর্বি লেগে থাকে তা সম্পূর্ণ কেটে ফেলে দিতে হবে। কারণ, ওই চর্বি আপনার রক্তের নালিতে গিয়ে জমে যাবে। রক্তের নালিতে চর্বি জমে গেলে রক্ত সঞ্চালনে বাধা পাবে। এতে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হতে পারে এবং হার্টঅ্যাটাকও হতে পারে। অতিরিক্ত মাংস খাওয়ার কারণে এ সময় নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই অল্প পরিমাণে মাংস খাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

খাবার হজম, শোষণ ও অপসারণের জন্য আমাদের গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্র্যাক্ট প্রতিনিয়ত কাজ করছে। সবচেয়ে দ্রুত হজম হয় কার্বোহাইড্রেট, অন্যদিকে ফ্যাট হজম হতে দীর্ঘসময় লেগে যায়।

গবেষকদের মতে, মাংসে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ফ্যাট রয়েছে। অন্যান্য খাবারের তুলনায় প্রোটিন ও ফ্যাট হজম হতে বেশি সময় নেয়। পাকস্থলি ও ক্ষুদ্রান্তে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হজম হতে তুলনামূলক বেশি সময় লেগে যায়, মূলত এসব খাবারের ফ্যাটই প্রক্রিয়াটিকে দীর্ঘায়িত করে থাকে। ফ্যাট হলো কমপ্লেক্স মলিকিউল, যা অন্যান্য খাবারের তুলনায় পাকস্থলি হতে বিলম্বে অপসারিত হয়। মাংস ও প্রাণীজ খাবারে ফ্যাটের পরিমাণ যে কোনো ফল বা সবজির চেয়ে বহুগুণে বেশি।

কোরবানির মাংস শুধু যে ক্ষতিকর তা নয়, কিছু ভালো উপাদান যেমন প্রোটিন, ভিটামিন-(বি১, বি৩, বি৬ ও বি১২), জিংক, সেলেনিয়াম, ফসফরাস ও আয়রন ভালো পরিমাণে এতে পাওয়া যায়। এই পুষ্টি উপাদানগুলোর স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও অনেক।

জিংকের ভালো উৎস হওয়ায় শরীরের জন্য কোরবানির মাংস উপকারী। জিংক দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, রুচি বাড়াতে, ক্ষত শুকাতে, দেহের বৃদ্ধি এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে।

অনেকেরই খাওয়ার পর ১২ থেকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাংস হজম হয়ে যায়। আবার অনেকেরই দুই দিন লাগতে পারে। এমনকি কারো কারো তিন-চারদিনও লেগে থাকে। পুষ্টিবিদদের মতে, ব্যক্তিভেদে মাংস হজম হতে দুই থেকে চার দিনও নিতে পারে। মাংস ভোজন পরবর্তী কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারণ হলো- হজম হতে বেশি সময় লাগে।

কোরবানির মাংস একটানা মাংস খেয়ে গেলে তৈরি হতে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সাধারণত কোনো সুস্থ ব্যক্তি সপ্তাহে দুই দিন লাল মাংস গ্রহণ করলে তা তেমন কোনো জটিলতা তৈরি করে না। তবে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতাসহ অন্য রোগ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মাংস খেতে হবে। মাংসের হজম বাড়ানোর কিছু উপায় উল্লেখ করা হলো।

মাংসের হজম দ্রুতকরণের একটি কার্যকরী উপায় হলো, ভালোমতো চাবানো। যত বেশি চাবাবেন, তত দ্রুত হজম হবে।গবেষণায় দেখা গেছে, মাংসকে বেশি ভাঙলে অর্থাৎ চাবালে গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডের নিঃসরণ বাড়ে। এটা পাকস্থলির পরিবেশকে অধিক অ্যাসিডিক করে তোলে, যার ফলে মাংস দ্রুত হজম হয়।

আনারসের মতো পেঁপে খেলেও মাংস হজমের দীর্ঘসূত্রিতা এড়ানো সম্ভব হবে। পেঁপেতে পাপাইন নামক প্রাকৃতিক এনজাইম রয়েছে। এটাও হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। এই ফল মাংস খাওয়ার পরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতেও সাহায্য করে, যেমন- পেটফাঁপা ও বদহজম।

মাংস খাওয়ার সময় অথবা আগে কয়েক টুকরো আনারস খেলে দ্রুত হজম হবে। আনারসে ব্রোমিলেন নামক প্রাকৃতিক এনজাইম থাকে, যা প্রোটিনের মধ্যকার সংযুক্তি ছাড়াতে সাহায্য করে। এর ফলে মাংস হজমে সহজতা আসে।

মাংস খাওয়ার পরপরই দই, কেফির বা অন্যান্য প্রোবায়োটিক খেলে হজমে গতিশীলতা আসবে। প্রোবায়োটিককে প্রচুর পরিমাণে উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।

মাংস হজম প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা কমানোর একটি সেরা উপায় হলো, মাংসকে রান্নার পূর্বে অ্যাসিড জাতীয় খাবার বা ভিনেগার দিয়ে কিছু ঘন্টা মেরিনেড করা। এভাবে মেরিনেড করলে মাংসের প্রোটিন সহজে ভেঙ্গে যাবে ও হজমের গতি বাড়বে।

যদি চান যে মাংস খাওয়ার পর তাড়াতাড়ি হজম হোক, তাহলে উচ্চ ফ্যাটের মাংসের পরিবর্তে কম ফ্যাটের মাংস খান।গবেষকদের মতে, কম ফ্যাটের মাংস সহজে ও দ্রুত হজম হয়। এই ধরনের মাংসও সীমিত পরিমাণে খাওয়া স্বাস্থ্য সচেতনতার লক্ষণ।

হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের গরু ও খাসি খাওয়া একেবারেই নিষেধ। তবে চর্বি ছাড়া গরুর মাংস খেতে পারেন। তাও খুব কম পরিমাণে। সরাসরি মাংস না খেয়ে রুটি বা ভাত দিয়ে খেতে পারেন। তবে মাংসের ঝোল খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

কিডনির সমস্যায় রোগীরা মাংস না খাওয়াই ভালো। তবে দিনে ৩০ গ্রাম পরিমাণ খেতে পারেন এর বেশি নয়। যাদের কিডনি ডায়ালাইসিস করানো হয়েছে তারা প্রোটিন পেতে গরুর মাংস খেতে পারেন।

অনেকের গরুর মাংসে অ্যালার্জি রয়েছে। তাদের মাংস খেলে শরীরে চুলকানিসহ লাল লাল ছোপ দেখা দেয়। তাই তারা গরুর মাংস এড়িয়ে চলুন। তবে ঈদের দিন খেতে চাইলে খুব অল্প পরিমাণ খান সেই সঙ্গে হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খেয়ে নিন।

ডায়াবেটিস রোগীদের সব খাবারই পরিমিত পরিমাণ খেতে হয়। তাই মাংস খেতেও সতর্ক থাকুন। মাংসের বিরিয়ানিও খান কম। তবে মাংস খেলেও এর কলিজা ও মগজ খাবেন না। যেদিন গরুর মাংস খাবেন সেদিন ইনসুলিন দুই ইউনিট বাড়িয়ে নিন।

উচ্চ রক্তচাপ যাদের আছে তারা চর্বি ছাড়া মাংস খাবেন। অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না।

অনেকের মাংস হজমে সমস্যা দেখা দেয় তাই তারা বেশি মসলাজাতীয় সেই সঙ্গে অতিরিক্ত মাংস খাবেন না। খুব বেশি সেদ্ধ না হলে খাবেন না। এছাড়া মাংস খাওয়ার পর দ্রুত হজম হতে আদা পানি অথবা শুধু আদাও খেতে পারেন।

দৃশ্যমান জমানো চর্বি বাদ দিয়ে রান্না করতে হবে। কম তেলে রান্না করতে হবে। উচ্চ তাপে রান্না করতে হবে।

মাংস রান্নার সময় ভিনেগার, টক দই, পেঁপে বাটা, লেবুর রস ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। এতে চর্বির ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।

প্রতি বেলায় খাবারের সঙ্গে এক কাপ পরিমাণ শসা, লেবু, টমেটো ইত্যাদির সালাদ রাখতে হবে।

খাওয়ার কিছু সময় পর তালিকায় লেবু পানি বা টক দই রাখলেও তা হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।

তিন বেলা মাংসের তৈরি ভারি খাবার না খেয়ে যেকোনো এক বেলা একেবারেই হালকা খাবার, যেমন সবজির স্যুপ, সবজি ও ফলের নানা আইটেম রাখতে পারেন।

প্রতি বেলায় ঘরে রান্না করা মাংস ১৫ গ্রাম, ২৫ গ্রাম বা দুই-তিন টুকরার বেশি খাবেন না।

মাংস উচ্চতাপে ভালভাবে সেদ্ধ করে খেতে হবে। সবচেয়ে ভাল আগুনে ঝলসে খেতে পারলে। এতে জীবাণুর সংক্রমণের ঝুঁকি থাকেনা। আধা সেদ্ধ মাংস বা স্টেক পরিহার করাই ভাল।

কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে প্রচুর পরিমাণে পানি, সরবত, ফলের রস, ইসবগুলের ভুষি ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি করে খাবেন।

(ঢাকাটাইমস/১৯ জুন/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মে দিবস: বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা
ছাত্রলীগ নেতার ভিডিওর প্রশংসা নোবিপ্রবি অধ্যাপকের
ওষুধ ছাড়াই ঘরোয়া উপায়ে দূর করুন হজমের সমস্যা
সব দেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে বাংলাদেশ: প্রেস সচিব
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা