মে দিবস: বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। এটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও সম্মান অর্জনের জন্য আত্মত্যাগের দিবস। ভারত ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হচ্ছে। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়ে থাকে।
এটি কেবল একটি দিন নয়; এটি একটি আন্দোলনের প্রতীক। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার শহিদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হন।
আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে সংঘটিত শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও আত্মত্যাগের মহিমা আজ বিশ্বের নানা প্রান্তে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে আলো দেখিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ কতটা তাৎপর্যপূর্ণ?
বাংলাদেশ একটি শ্রমনির্ভর দেশ। কৃষি, তৈরি পোশাক, নির্মাণ ও পরিবহন খাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবদান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রশংসিত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন শ্রমিক কাজ করছেন বলে ২০২৪ সালে সংসদের এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী।
বাংলাদেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত তৈরি পোশাক শিল্পের উত্থান ছিল আকস্মিক। ১৯৮৩-৮৪ সালে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৪ শতাংশেরও কম ছিল পোশাক শিল্প। পরবর্তী এক দশকের মধ্যে এই অংশ ৬০ শতাংশে উন্নীত হয় এবং ২০২২-২৩ সালে সর্বোচ্চ ৮৪ শতাংশে উন্নীত হয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। শুধুমাত্র চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তৈরি পোশাক শিল্পের বাস্তব চিত্রে দেখা যায়, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার আজও অনেক ক্ষেত্রে অমীমাংসিত। অথচ দেশের জিডিপিতে এই খাতের অবদান ১০ শতাংশ। গত ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৫৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে।
এই মুহূর্তে তৈরি পোশাক শিল্পসহ দেশের প্রযুক্তি খাত, কৃষি খাত, নির্মাণ ও শিক্ষা খাতে আরো বিনিয়োগ বাড়লে দেশের বেকারত্বের হার দ্রুত কমে আসতে পারে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত এক দশক ধরেই দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ থেকে ২৭ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও একটি দেশে সত্যিকারের বেকার সংখ্যা কত সেটা না জানতে পারাটা অনাঙ্ক্ষিত ব্যাপার।
গত বছর জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যে বসবাসকারী ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ। আর বিশ্বের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন। একই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশের বসবাস মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। দরিদ্র মানুষের ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ গ্রামে বসবাস করেন।
বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্যে বসবাসকারী জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে হলে দেশের তরুণ ও যুবকদের গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫-২৯ বছরের তরুণদের সংখ্যাই ৪ কোটি ৬০ লাখ। এছাড়া দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৭ লাখেরও বেশি। এদের মধ্যে প্রতি বছর একটি বড় সংখ্যা পড়াশোনা শেষ করে ক্যারিয়ার গড়ার যুদ্ধে লিপ্ত হন। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার দরুন অনেকে বেকারের খাতায় নাম লেখান। যাদের নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। দেশের প্রযুক্তি খাতে জিডিতে প্রায় ৭ শতাংশ অবদান রাখছে, যেখানে তরুণদের একটি বড় অংশ কাজ করছেন।
আমাদের মোট জনসংখ্যার ৭২.২৮ শতাংশ শ্রম শক্তির অংশ যার মধ্যে ৪৮.০৪ শতাংশ পুরুষ ও ২৪.২৪ শতাংশ নারী। এই বিশাল শ্রমশক্তির পূর্ণ ব্যবহার না করতে পারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বাধা। আমাদের তরুণরা বা আমাদের যুব শ্রমশক্তি বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩৬.৫৩ শতাংশ । এটি একটি বিশাল সম্ভাবনাময় কর্মীবাহিনীর ইঙ্গিত দিচ্ছে, তবে বেকারত্ব এবং সুযোগের অভাব নতুন করে উদ্বেগও জাগাচ্ছে।
আমাদের দেশের বিশাল এই শ্রমশক্তির পূর্ণ ব্যবহার করতে হলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার বিকল্প নেই। পাশাপাশি জনগণের মধ্যে আর্থিক জ্ঞান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কারণ দেশের প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ এখনো আর্থিক জ্ঞান সম্পর্কে সচেতন নয়। এমনকি আমাদের দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে। একটি দেশের সমষ্টিগত উন্নয়নে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের বিকল্প নেই।
একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে যে আর্থিক শিক্ষায় শিক্ষিত বর্তমান তরুণেরা নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হচ্ছেন। তারা পুঁজিবাজারে সক্রিয়ভাবে বিনিয়োগ করছেন। সেখানে ৭০ শতাংশ খুচরা বিনিয়োগকারীর বয়স ৪৫ বছরের কম। তাদেরকে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করার জ্ঞান ও পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হলে এই খাতে আরো সম্ভাবনা তৈরি হতো।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও সত্য যে একদিকে কিছু বড় কারখানায় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন হলেও, অনেক ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানে এখনো শ্রম আইন উপেক্ষিত। দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যু, চাকরি হারানোয় যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পাওয়া, শ্রম আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো যেন এখনো মে দিবসের মূল দর্শনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তবুও আশার আলো রয়েছে। গত এক দশকে শ্রমিক সংগঠনগুলো অধিক সচেতন ও সক্রিয় হয়েছে। ডিজিটাল মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শ্রমিকদের কণ্ঠকে আরও প্রবল করেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও ন্যূনতম মজুরি বোর্ড, মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিনের বদলে ১২০ দিন হবে যা অনেক কারখানা ১২০ দিন কার্যকর করেছে, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে সম্প্রতি সরকার ঘোষিত ৯ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন শুধু পোশাক খাতের জন্য। সেটাও আবার অধিকাংশ কারখানা কার্যকর করেনি। এছাড়া শ্রম আইনের খসড়াতে শ্রমিকদের ভবিষ্য তহবিল ও গ্র্যাচুইটি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে না বা এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমলে নেওয়া হচ্ছে না বলে একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে। এরকম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে সকল গ্যাপগুলো রয়েছে, তা দূর না হলে মে দিবসের তাৎপর্য সীমাবদ্ধ হয়েই থাকবে।
বাংলাদেশের অতীত যে শ্রমজীবী মানুষের ঘামে নির্মিত ও ভবিষ্যৎ যে শ্রমজীবী মানুষের ঘামে বিনির্মাণ হবে, তা আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই। মে দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত—শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
লেখক: এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক
ই-মেইল: [email protected]

মন্তব্য করুন