প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সেবা পাওয়ার বাস্তবতা: সরাসরি অভিজ্ঞতার আলোকে পর্যালোচনা সভা

অলাভজনক ও অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজঅ্যাবেলড ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট (বিডিডিটি) ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও জীবনের মানোন্নয়নে কাজ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে একটি বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার মূল উদ্দেশ্য—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কী ধরনের সরকারি সেবা পাচ্ছেন, কোথায় ঘাটতি আছে সেগুলো সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছে প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবনা তুলে ধরা।
মতবিনিময় সভায় শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. দেলোয়ার হোসেন সুজন বলেন, “সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—কোনো অফিসে যেতে পারি না। র্যাম্প নেই, হুইলচেয়ার চালিয়ে ঢোকা সম্ভব না। সরকারি কার্ড করতে গেলে একাধিক জায়গায় যেতে হয়। সেটা যেন সহজে করা যায়, সে ব্যবস্থা দরকার।”
সিরাজগঞ্জের একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অংশগ্রহণকারী বলেন, “কেন্দ্রে গিয়েছি, দেখি যারা সেবা পাচ্ছেন তারা প্রকৃত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি না। লজিস্টিক সাপোর্ট চাইলে সেখান থেকে বলে নাই। পরিচিত না হলে আবেদনের ফর্মও দেয় না।”
শাহীনুর মির্জা নামের একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী নারী বলেন, “আমি ২১ দিন হাসপাতালে ছিলাম, কিন্তু হুইলচেয়ারের জন্য আলাদা টয়লেট না থাকায় ওয়াশরুমে যেতে পারিনি। মাথায় রক্ত জমে যায়। এটা শুধু আমার না, অনেকেরই সমস্যা। সরকারকে এটা দেখতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করা ইকবাল হোসেন নামের একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তার বক্তব্যে প্রতিবন্ধী সেবা কেন্দ্রগুলোতে কর্মরত লোকদের আন্তরিকতার অভাব তুলে ধরেন।
সেবা না পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি আন্তরিকতার অভাব ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা দরকার। এছাড়া আমার কাছে মনে হয় ফাউন্ডেশনগুলো অল্প বিষয় নিয়ে কাজ করে, সকল ধরনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে না। এজন্য ক্যাটাগরি অনুযায়ী কাজের পরিধি বাড়াতে হবে। জবাবদিহি, তদারকি বাড়াতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার, বাজেটটা বাড়ানো দরকার। বাজেট যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তদারকি দরকার। প্রতিবন্ধী মানুষের বেসিক প্রয়োজনগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।
আরেকজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রাসেল হাওলাদার বলেন, “আমরা জানিই না কোথায় সেবা পাওয়া যায়। প্রচার দরকার। জবাবদিহি, তদারকি বাড়ানো দরকার।"
তিনি আরও বলেন, আমাদের সবথেকে বড় বাধা আমরা কোনো অফিস বা আমাদের সাহায্য সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন অফিসে গেলে একা মুভ করা সম্ভব হয়না। এর প্রধান কারণ অফিসগুলোর র্যাম্প। সেক্ষেত্রে অফিসগুলোতে আমাদের জন্য র্যাম্পগুলোর দিকে নজর দেওয়ার অনুরোধ করছি।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মৌমিতা রানী বলেন, “প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের বিষয়ে জানে এমন মানুষ নিয়োগ দেওয়া উচিত। সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্পেইন প্রয়োজন।”
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শাহিনা আক্তার আশা বলেন, “আমাদের ক্ষেত্রে সমাজে পদে পদে বাধা। আমাদের জন্য আইন আছে, কিন্তু তা প্রয়োগে ইচ্ছার অভাব। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার।”
বিডিডিটির অবস্থান সম্পর্কে বিডিডিটির সিইও মনিরুজ্জামান খান বলেন, “আমরা ২০০৯ সালে নিবন্ধিত হই। তখন থেকে এ পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। কোভিড, সিডর, আইলা—সব ধরণের দুর্যোগের সময় পাশে থেকেছি। আমাদের টার্গেট—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেন সমাজে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে।”তিনি আরও বলেন, “আমরা ৩২টি সেবা কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। দেখেছি—কী ঘাটতি আছে, কী প্রয়োজন, সেবাদাতাদের সক্ষমতা কতটুকু। এরপর ৮টি বিভাগে ফলোআপ করছি। এসব পর্যালোচনা করে সরকার ও দাতা সংস্থার কাছে সুপারিশ পাঠাব।”
বিডিডিটির প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. মবিনুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, মেট্রোরেলে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য একটা বগি বানানোর প্রয়োজন। এছাড়া সেবা কেন্দ্রে যারা কাজ করে তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে। সেবাগ্রহীতাদের সাথে কথা বলার ধরণ এমন হতে হবে যেন তারা আঘাত না পায়।
সুপারিশ ও অগ্রাধিকার
* প্রতিবন্ধী সেবা কার্ড প্রক্রিয়া সহজ করা
* সব সরকারি হাসপাতালে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য উপযোগী টয়লেট নিশ্চিত করা
* তথ্য ও সেবার ব্যাপারে প্রচার বৃদ্ধি
* প্রকৃত সেবাপ্রত্যাশীদের শনাক্তে সঠিক যাচাই ও জবাবদিহিতা
* সকল ক্যাটাগরির প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী সেবা কাঠামো তৈরি
* বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো ও যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করা
* মেট্রোরেলে প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ বগি নিশ্চিত করা
মন্তব্য করুন