ক্যানসার নিরাময়ে কার্যকর ভেষজ ঔষধি জাফরান

বিশ্বের সবচেয়ে দামি মশলা জাফরান বা কেশর। প্রাচীনকাল থেকেই জাফরানকে একটি ভেষজ মশলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাফরান শুধু খাবারের রঙ এবং স্বাদ বৃদ্ধি করে না, জাফরান আয়ুর্বেদিক থেকে শুরু করে প্রায় সকল ধরনের চিকিৎসা খাতে ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় জানা যায় যে জাফরান মানব দেহের প্রায় ২০ ধরনের রোগ সারাতে সক্ষম। এতে বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ ও মিনারেলসহ প্রায় ১২০ ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান।
জাফরান বা ইংরেজিতে স্যাফরনকে লাল সোনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যার বৈজ্ঞানিক নামা করোকাস স্যাটিভাস। আদি জন্মস্থল হলো ইরান তবে এ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। কারণ সে সময়ে মিসরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতায় জাফরান ব্যবহার করার নজির পাওয়া যায়। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে আকিকার সময় নবজাতকের মাথার চুল ফেলে দেওয়া হতো। এরপর সেই নবজাতকের মাথায় আকিকার পশুর রক্ত লাগিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু নবী সা. বলেছেন, তোমরা পশুর রক্ত লাগানো বন্ধ করে দাও এবং সেখানে রঙ মাখো। সবচেয়ে ভালো হলো জাফরানের রঙ। হাদিসটি নবী (সা.)-এর মেয়ে ফাতিমা (রা.) থেকেও বর্ণিত হয়েছে।
জাফরান হল ক্রোকাস স্যাটিভাস ফুলের শুকনো শিস বা গর্ভমুণ্ড। এটি একটি সুতোর মতো কাঠামোর হয় যা ফুলের কেন্দ্রস্থলে পরাগ ধরে থাকে। জাফরান গাছটি চারটি ফুল বহন করে, যা থেকে স্টাইলিশ এবং ক্রিমসন রঙের শিস সংগ্রহ ও শুকোনো হয়। একটি ফুল থেকে জাফরানের তিনটি সুতো পাওয়া যায় এবং এক পাউন্ড জাফরান তৈরি করতে প্রায় ১৪০০ জাফরান সুতো লাগে।
জাফরান ফুল দিতে পারলেও এর থেকে কোনো ফল হয় না। সে কারণে এই উদ্ভিদ উৎপাদন করতে সরাসরি মানুষের হস্তক্ষেপ লাগে। তো এই উদ্ভিদের ফুলের পাপড়ি বেগুনি রঙের হয় এবং ভিতরে থাকা লাল দণ্ড হলুদ ও কমলা রঙের মিশ্রণে লাল বর্ণ ধারণ করে। মূলত ফুলের ভেতরে থাকা এই লাল পরাগ দণ্ড যখন শুকানো হয় তখন তা জাফরান হিসেবে পরিচিতি পায়। বিশ্বব্যাপী এই মশলার কদর সব থেকে বেশি। বিশেষ করে বড় বড় অনুষ্ঠান এবং পার্টিতে খাবার রান্না ও পরিবেশন করার জন্য জাফরান ব্যবহার করা হয়।
জাফরান ফুল মাটি থেকে প্রায় ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় হয় এবং সূর্য উদয়ের সাথে সাথে এই ফুল সংগ্রহ করতে হয়। মোটকথা এই ফুল উৎপাদন করা থেকে মশলা তৈরি করার আগে পর্যন্ত অনেক পরিশ্রম করতে হয় এই কারণে এর দাম এত বেশি হয়ে থাকে। তাছার গোটা বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশে জাফরান চাষ হয় যাদের মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম। আমরা মূলত জাফরান বলতে কাশ্মীর থেকে আশা জাফরান কেই বুঝি। অতিমূল্যবান এই মসলার বাজারে একক আধিপত্য উপসাগরীয় দেশ ইরানের। একাই বিশ্বের ৮০ শতাংশ জাফরান উৎপাদন করে থাকে এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। আর বিশ্বের সবচেয়ে ভালো মানের জাফরান পাওয়া যায় আরেক মুসলিম দেশ আফগানিস্তানে।
২০১৯ সালে ২৫০ টন জাফরান উৎপদন করেছিল ইরান। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা দাঁড়ায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
ইরান ছাড়াও ভারত, স্পেন, গ্রিস, মরক্কো, ইতালি, আজারবাইজান, তুরস্ক ও আফগানিস্তানে চাষ হয় মহামূল্যবান এই মসলা। তবে ইরানের তুলনায় তাদের উৎপাদিত জাফরানের পরিমাণ খুবই কম।
অন্যদিকে স্যাফরন বা রেড গোল্ড খাবারের সৌন্দর্য এবং স্বাদ বৃদ্ধি করে। তবে প্রচলিত উপায়ে এটি উৎপাদন করা যায় না। এমনকি সব ধরনের মাটিতে এই উদ্ভিদ জন্মানো সম্ভব হয় না। অন্যদিকে এক কিলোগ্রাম জাফরান মশলা উৎপাদন করতে প্রয়োজন হয় প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার ফুলের যা তুলতে সময় লাগে প্রায় ৪০ ঘণ্টা। উন্নতমানের এক কেজি জাফরানের মূল্য সর্বোচ্চ ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৫ লাখ টাকারও বেশি।
বেশ কিছু কারণে জাফরানের দাম এত বেশি। প্রথমত এর আহরণ প্রক্রিয়া বেশ জটিল। প্রাচীন পদ্ধতিতে হাতের মাধ্যমে ফুল থেকে জাফরান সংগ্রহ করা হয়। কেন জাফরানের দাম এত বেশি, ছোট একটি উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। মাত্র ১ পাউন্ড বা ৪৫৩ গ্রাম জাফরান পেতে প্রয়োজন ১ লাখ ৭০ হাজার ফুল।
দামি এই মসলা নিয়ে গবেষণা করছেন, ইউনিভার্সিটি অব ভার্মন্টের গবেষক আরাশ গালে। তিনি বলেন, বেশ কিছু জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই মসলা চাষ করতে হয়। খেত থেকে ফুল সংগ্রহ, ফুল থেকে কাঠি বের করে আনা এবং সেগুলো শুকিয়ে জাফরান বানানোর প্রতিটি ধাপ হাতের মাধ্যমে করতে হয়। এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন।
ক্যানসার মোকাবিলা, হার্টের উপকার, ত্বকের উজ্বলতা বৃদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে দারুণ কার্যকরী এই মসলা। ঔষধীগুণেও সমৃদ্ধ এটি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে আগুন রঙা এই জাফরান। জেনে নিন জাফরানের স্বাস্থ্য উপকারিতা-
ক্যানসার নিরাময় করে
জাফরান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফ্ল্যাভোনয়েড সমৃদ্ধ। যা ফ্রি র্যাডিকালগুলোকে নিরপেক্ষ করতে সহায়তা করে। ফ্ল্যাভোনয়েডগুলো একটি রাসায়নিক। এটি উদ্ভিদকে রোগ এবং ছত্রাক থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। টেস্ট টিউব স্টাডিতে দেখা গেছে যে, জাফরান এবং এর যৌগগুলি কোলন ক্যানসার কোষগুলোকে মেরে ফেলে। এই প্রক্রিয়াতে স্বাস্থ্যকর কোষগুলো আমাদের দেহে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় ফুসফুস, স্তন, প্রোস্টেট, জরায়ু এবং অন্যান্য ক্যানসার প্রতিকার হয়। জাফরানে ঘণ কমলা রঙের জলে মিশে যায় এমন এক ধরনের ক্যারোটিন থাকে, যাকে ক্রোসিন বলা হয়। এই ক্রোসিনের জন্যই খাবারে জাফরান ব্যবহার করলে একটা উজ্জ্বল সোনালি রং হয় খাবারে। এই ক্রোসিন শুধুমাত্র খাবারে সোনালি রং-ই আনে না, আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধরণের ক্যানসার কোষ, যেমন লিউকেমিয়া, ওভারিয়ান কারসিনোমা, কোলন অ্যাডেনোকারসিনোমা প্রভৃতি ধ্বংস করতেও সাহায্য করে।
স্বাস্থ্য উন্নত করে
নিয়মিত জাফরান খেলে তা হরমোন উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ আপনার শরীর যদি রোগা হয় বা সব সময় অসুখ লেগেই থাকে তাহলে জাফরান সেবন আপনার স্বাস্থ্য উন্নত করে। এতে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান দেহের সকল সমস্যা সমাধান করে এবং শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
হার্টের জন্য ভালো
জাফরানে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। এরা রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করতে পারে। যার ফলে আপনি হৃদরোগ থেকে সুরক্ষা পাবেন। জাফরান শরীর থেকে খারাপ কোলেস্টেরল দূর করে থাকে। জাফরানের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যগুলো হৃদরোগের জন্য প্রতিরক্ষামূলক উপাদান হিসাবে কাজ করতে সহায়তা করতে পারে।
যৌনতার ইচ্ছা বাড়ায়
যৌনতার ইচ্ছার অনুঘট হিসেবে কাজ করে জাফরান। এটি প্রাকৃতিক উপাদান বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম। খাবারে জাফরান দিলে তা চাপ কমাতে সাহায্য করে, যৌনতার ইচ্ছাও বাড়ায়। এটি রক্তে ইস্ট্রোজেন, সেরোটোনিন এবং অন্যান্য ফিল-গুড হরমোন উৎপাদন বৃদ্ধি করে। জাফরান উদ্বেগ হ্রাসে সহায়তা করে।
হতাশা দূর করে
জাফরান আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। আচরণগত এবং মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, জাফরানের নির্যাস মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে ভূমিকা পালন করে। অন্য একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে, প্রতিদিন ৩০ মিলিগ্রাম জাফরান গ্রহণের ফলে এমন প্রভাব দেখা দিতে পারে। যা ইমিপ্রামাইন এবং ফ্লুওক্সেটিন ড্রাগ চিকিত্সার অনুরূপ। মানুষ ড্রাগ চিকিৎসার তুলনায় জাফরান ব্যবহার করে কম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনুভব করে। হতাশা দূর করার জন্য জাফরান কার্যকর।
পিএমএস লক্ষণগুলোতে সহায়তা করে
পিএমএস হল প্রাক মাসিক সিন্ড্রোম। মহিলাদের পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে মানসিক, শারীরিক এবং সংবেদনশীল লক্ষণগুলো পিএমএস । জাফরান পিএমএসের লক্ষণগুলো মোকাবেলায় কার্যকর হতে পারে। কিছু গবেষণা অনুসারে এটি পিএমএস সম্পর্কিত হতাশার লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করে। ২০-৪৫ বছর বয়সী মহিলাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ৩০ মিলিগ্রাম জাফরানের নির্যাস গ্রহণ করলে তৃষ্ণা, মাথাব্যথা, এবং বিরক্তির মতো পিএমএস লক্ষণগুলি কমে যায়। ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে এটি একটি ভাল বিকল্প হতে পারে।
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে
যেহেতু জাফরান হরমোন উদীপ্ত করে এবং রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে সেহেতু এটি মস্তিষ্কের জন্য অনেক উপকারী। বিশেষ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল তারা জাফরান খেলে তাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।
রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে
জাফরানে পরিমাণ মত পটাশিয়াম থাকে যা শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে। এতে ব্লাড সার্কুলেশন কোনো ঝামেলা ছাড়াই সম্পন্ন হয়। এতে দেহের মরা কোষ উজ্জীবিত হয়। অন্যদিকে সঠিক মাত্রায় রক্ত চলাচল হওয়ায় তা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
রক্তস্বল্পতা দূর করে
জাফরান মশলায় ব্যাপক পরিমাণ আয়রন থাকে। এই খনিজ উপাদান রক্ত পরিশুদ্ধ করে এবং রক্ত তৈরি হওয়া বৃদ্ধি করে। এতে দেহের রক্তস্বল্পতা দূর হয় এবং রক্তের কারণে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা নিরসন হয়।
অনিদ্রা দূর করে
অনিদ্রা স্বাভাবিক জীবন যাপন বিঘ্নিত করে। কারণ যখন ঘুম হয় না তখন দুশ্চিন্তা অন্তরে বাসা বাঁধে। এতে শরীর এবং স্বাস্থ্য দুটোই খারাপ হতে থাকে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য জাফরান অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে
অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকারী উদ্ভিদের মত জাফরান কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে এই মশলা দেহের জন্য ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল দূর করে এবং উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দূর করে
সর্দি এবং কাশির যে ধরনের সমস্যা হয় যেমন অ্যাজমা ও পারটুসিস দূর করতে জাফরান খাওয়া যেতে পারে। কারণ সর্দি-কাশির সমস্যা দূর করতে এই মশলা অনেক ভালো কাজ করে।
চোখের ছানি রোধ করে
জাফরান নিয়মিত খেলে তা চোখের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ছানি পরা ও দুর্বল দৃষ্টি শক্তি নিরাময় করতে সহায়তা করে।
আসিডিটি দূর করে
জাফরান মশলা হজম সমস্যা দূর করে এবং পেটের পিরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গাস দূর করে। এতে আসিডিটি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
জাফরান খাওয়ার সব থেকে উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে রাতের বেলা। বিশেষ করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুধের সাথে মধু ও কিশমিশ মিশিয়ে তাতে জাফরান দিয়ে খাওয়া সব থেকে বেশি উপকারী। এগুলো বাদেও বিভিন্ন বাদাম বা অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যোগ করে জাফরান দুধের শোভা বৃদ্ধি করা যায়।
গরম পানিতে কয়েকটি জাফরান ভিজিয়ে রাখতে পারেন। এটি চা হিসাবে পান করতে পারেন। জাফরান মাংস, শাকসবজি বা বেকড পণ্য রান্না করার সময়ও ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো খাবারের স্বাদ আরও বাড়িয়ে তুলবে। খাবারে হলুদ-কমলা রঙ যুক্ত করবে।
প্রতিদিন ১.৫ গ্রাম জাফরানের নির্যাস নিরাপদ হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে এর চেয়ে বেশি গ্রহণ করলে বিষাক্ত হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বেশি জাফরান খেলে অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। উচ্চ পরিমাণে জাফরান খেলে ভ্রূণের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। অনেক সময় গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ায়। অতএব গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়ানো মহিলাদের অবশ্যই উচ্চ মাত্রায় জাফরান খাওয়া এড়ানো উচিত।
(ঢাকাটাইমস/২২ জুন/আরজেড)

মন্তব্য করুন