ভ্যাপসা গরমে ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়
ঋতু বদলের পর মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু গরম কমছে না। বরং বৃষ্টির পর গরম যেন আরও বেড়ে যায়। বাইরে চড়া রোদ। ঘাম, গরম, রোদ্দুর আর শরীর জ্বালা-পোড়া এখন নিত্যসঙ্গী। সেই সঙ্গে রয়েছে ডিহাইড্রেশন, ক্লান্তি, মাথা ঘোরার মত সমস্যা। এছাড়াও যে কোনও রকম ত্বকের সমস্যা বাড়ে গরমে। ঘামাচি, অ্যালার্জি বা হঠাৎ করে কোথাও লাল হয়ে যওয়া এই সব সমস্যা তো থাকেই। গরমে যেমন হিট স্ট্রোকের সমস্যা বাড়ে তেমনই সর্দি-গর্মি, জ্বর, ফুড পয়জন, পেটের সমস্যা, ডায়ারিয়া এসবও কিন্তু অনেক বেশি হয়। অল্পেই শরীরে ক্লান্তি আসে। রোদের মধ্যে কিছুক্ষণ থাকলেই মাথা ব্যথার মত সমস্যাও কিন্তু পিছন ছাড়ে না।
ভ্যাপসা গরমে অনেকের মুখের ভিতরটাও বারবার শুকনো হয়ে যায়। অফিসে কাজ করতে-করতে ঝিমুনি, মাথা ব্যথা হয় ক্রমাগত। কাঠফাটা গরমে এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে অনেকেরই। পাত্তা দেন না বেশির ভাগ মানুষ। নিয়মিত এই সব লক্ষণকে পাত্তা না দেওয়ার ফল কিন্তু ভুগতে হতেই পারে। কারণ, এ সবই হয়তো হচ্ছে ডিহাইড্রেশনের কারণে। ডিহাইড্রেশনে কাবু হচ্ছেন অনেকেই। শরীরে নিয়মিত পানির ঘাটতি হলে, রক্তচাপ কমে গিয়ে আচমকা সংজ্ঞা হারানোর মতো বিপত্তি হতে পারে।
ভ্যাপসা গরমে শরীরে পানির প্রয়োজন বেশি হয়। কিন্তু সে দিকে খেয়াল না রাখার ফলে ডিহাইড্রেশনের শিকার হন অনেকেই। কিন্তু শুধু গরমের কারণেই এমনটা হয়, তা ঠিক নয়। জ্বর, ডায়েরিয়া বা কোনও কারণে বারবার বমি হলেও ডিহাইড্রেশন হতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত ব্যায়াম করলেও শরীরে জলের অভাব দেখা দিতে পারে। তা পূরণে নজর না দিলেই মুশকিল। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বারবার প্রস্রাবের ফলেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের খাবারও শরীরে পানির পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
সাধারণত গরমের সময় শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ঘাম হয়ে বের হয়। এতে শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে শরীরে অস্বস্তি, ক্লান্তির মত একাধিক উপসর্গ দেখা দেয়। তাই শরীর হাইড্রেটেড রাখতে আপনাকে খেতে হবে পানি ও পানিযুক্ত খাবার।
সাধারণত বডি ফ্লুইড কমে গেলে ডিহাইড্রেশন হয়। আমরা যে পরিমাণ পানি খাই তারচেয়ে বেশি পরিমাণ পানি যখন শরীর থেকে বের হয়ে যায় তখন ডিহাইড্রেশন হতে পারে।
শরীর থেকে পানি বিভিন্ন উপায়ে বের হয়- শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলার সময় বাষ্পীভূত হয়ে, ঘাম, ইউরিন ইত্যাদির মাধ্যমে। এসবের মাধ্যমে শরীর থেকে শুধু পানিই না, প্রয়োজনীয় লবণও অপসারণ হয়। তখন শরীর স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ডিহাইড্রেশন হয়।
ডিহাইড্রেশন বিভিন্ন কারণে হতে পারে। জ্বর, রৌদ্রতাপে চলাফেরা, অতিরিক্ত ব্যায়াম, বমি, ডায়রিয়া ও ইনফেকশনের কারণে অতিরিক্ত ইউরিনেশন ইত্যাদি। এছাড়াও যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদেরও ডিহাইড্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যারা প্রয়োজন অনুপাতে কম পানি খান বা প্রচুর ঘামেন কিন্তু সে পরিমাণে ফ্লুইড শরীরে প্রবেশ করে না তাদের ডিহাইড্রেশন হতে পারে। ফলে খরা ও শুষ্ক আবহাওয়াতে ডিহাইড্রেশন এড়াতে প্রচুর পানি পান করা উচিত।
প্রচুর তৃষ্ণাবোধ, মুখ ও জিহ্বা শুকিয়ে আসা, দুর্বলতা, মাথা ঘোরোনো, পালপিটিশন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি ড্রিহাইড্রেশনের লক্ষণ। ডিহাইড্রেশন চরম পর্যায়ে চলে গেলে ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ঘাম না হওয়া, ইউরিন কমে যাওয়া ইত্যাদিও ডিহাইড্রেশনের অন্য লক্ষণ।
শরীরে যাতে জলের জোগান না কমে, সে দিকে খেয়াল রাখা। তাই জল খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে। ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ দেখা দিলে নুন-চিনির জল খাওয়া প্রয়োজন। দিনে কয়েক বার তা খেলে শরীর অনেকটাই ঠিক থাকবে। এ ছাড়া মুখে বরফের টুকরো রাখলেও অনেকটা স্বস্তি মেলে। কেউ মারাত্মক ডিহাইড্রেশনে আক্রান্ত হলে মুখে বারবার জলের ঝাপটা দিলে ও ভিজে তোয়ালে শরীরে জড়িয়ে রাখলেও খানিকটা সুস্থ বোধ হয়।
ডিহাইড্রেশনের ফলে শুধু জল নয়, শরীরে খনিজ পদার্থেরও অভাব তৈরি হয়। তাই ঘোল বা লস্যি এবং ডাবের জলের মতো পানীয় উপযুক্ত। এ ছাড়া ইলেক্ট্রোলাইট রয়েছে এমন স্পোর্টস ড্রিঙ্কসেও ভাল কাজ হয়। ডিহাইড্রেশনে পটাশিয়ামের যে অভাব হয়, কলা তা খানিকটা পূরণ করতে পারে।
অতিরিক্ত কফি পান শরীরে জলের অভাব তৈরি করে। ভাজাভুজি খাবার বেশি খেলেও ডিহাইড্রেশন হয়। বিশেষত গরমে এগুলি তাই এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়।
ডিহাইড্রেশন এড়াতে দিনে প্রচুর পানি পান করুন। বিশেষ করে গরমের দিনে খেলাধুলা বা ব্যায়াম করার সময় প্রতি ১৫/২০ মিনিট অন্তর অন্তর পানি ও জুস পান করা উচিত। এসময় হাই প্রোটিনযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। যদি আপনি প্রোটিন বেসড ডায়েটে অভ্যস্ত হন তবে দিনে অবশ্যই আট থেকে ১২ গ্লাস পানি পান করতেই হবে। খাবারে পানিসমৃদ্ধ ফল ও সবজি যেমন- আঙুর, তরমুজ, আনারস, লেবু, শসা, টমেটো, লাউ, বাঁধাকপি, সেলারি ইত্যাদি রাখুন।
ভ্যাপসা গরমে প্রচুর পরিমাণ ফল খান, আম, কাঁঠাল, শসা, কলা, লিচু, তরমুজ, জামরুলের মতো ফল খান তাতে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করবে। রাতে খাওয়ার সময় অল্প পরিমাণে হাল্কা রান্না করা খাবার খান। নাশতায় দই-চিঁড়া, আম-চিঁড়া, ছাতু, রুটি, পাউরুটির মতো হাল্কা খাবার খান। ভাতের সঙ্গে প্রচুর শাকসবজি, ছোট-বড় মাছের হালকা রান্না করা খাবার খান তাতে শরীর সুস্থ থাকবে।
তাজা শাক-সবজি, ফল বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত আর প্রতিদিনের খাবার তালিকায় বাদাম জাতীয় খাবার রাখা প্রয়োজন।
রাস্তায় বানানো জুস খাওয়া যাবেনা, বিশেষ করে রাস্তা ঘাটে কাটা ফল, ফলের জুস যতটা সম্ভব কম খাওয়াই স্বাস্থ্যকর।
পাশাপাশি বর্জন করতে হবে বিয়ার ও ওয়াইনের মতো অ্যালকোহল। কারণ এগুলো ডিহাইড্রেশন বাড়িয়ে তোলে। অনেক সময় গ্লাসের পর গ্লাস পানি পান করলেও শরীর ঝিমিয়ে পড়ে। এমন কিছু খাবার আছে, যা গরমের সময়ে শরীরে পানির ঘাটতি আরও বাড়িয়ে দেয়। জেনে নিন, কোন কোন খাবার গরমের দিনে ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি কমাতে এড়িয়ে চলবেন।
লবণ: গরমের ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে লস্যি, লেবু-লবণ-চিনির শরবতে চুমুকও দিচ্ছেন। অনেকেই মনে করেন, ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে বিভিন্ন খনিজ বেরিয়ে যাওয়ার ফলে একটু বেশি পরিমাণ লবণ খেলে এই সময়ে কোনও ক্ষতি হবে না। এই অভ্যাস কিন্তু আদৌ ঠিক নয়। এতে শরীরে পানির ঘাটতি হয়। তাই কাঁচা লবণ, নোনতা স্ন্যাক্স, নোনতা আচার, প্রক্রিয়াজাত খাবার— গরমে না খাওয়াই ভাল।
চা-কফি: গরম পড়েছে বলে চা, কফি খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে পারছেন না? এই অভ্যাসের ফলে দেহের বাড়তে থাকা তাপমাত্রা জলের ঘাটতি তৈরি করে। ডিহাইড্রেশনের সমস্যাও বাড়তে পারে। তাই এই সময়ে গরম পানীয় এড়িয়ে চলাই ভাল।
ভাজাভুজি: চপ, পেঁয়াজি, শিঙাড়া খেতে যতই ভাল লাগুক, এই গরমে ভাজাভুজি একেবারেই খাওয়া যাবে না। ভাজা জাতীয় খাবারও কিন্তু শরীরে জলের ঘাটতি তৈরি করতে পারে। এ ছাড়াও, গরমে এ সব খাবার হজম করাও বেশ কঠিন। গরমের দিনে টিফিনে বার্গার, চিকেন ফ্রাই, ফ্রায়েড মোমো এই সব না খাওয়াই ভাল।
চিনি: গরমের দিনে রোদে বাইরে বেরোলেই আইসক্রিম, বরফের গোলা, নরম পানীয় খেতে ইচ্ছা করে, তবে অতিরিক্ত চিনি খেলেও শরীরে জলের ঘাটতি হয়। গরমের দিনে মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন কেক, পেস্ট্রি, চকোলেট— এই সব না খাওয়াই ভাল।
তেলমশলাদার খাবার: গরমের দিনে বার বারই চিকিৎসকেরা তেলমশলাযুক্ত খাবার খেতে বারণ করেন। এই সময়ে হালকা পাতলা খাবার খাওয়াই ভাল। কেবল বাড়িতেই নয়, অনুষ্ঠান বাড়িতেও বুঝেশুনে খেতে হবে। রেস্তোরাঁয় এই সময়ে না খাওয়াই ভাল।
(ঢাকাটাইমস/২৫ জুন/আরজেড)
মন্তব্য করুন