পিয়ন জাহাঙ্গীর এখন কোথায়? স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়েছেন আমেরিকায়?

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ব্যক্তিগত কর্মচারী (পিয়ন) জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ বিদেশে অবস্থান করছেন। প্রায় মাসখানেক আগে তিনি আমেরিকায় গেছেন। জাহাঙ্গীর আলমের পরিবার সূত্রে ঢাকা টাইমস এ তথ্য জানতে পেরেছে।
সূত্র বলছে, একসময় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী বা পিয়ন হিসেবে কাজ করেছেন জাহাঙ্গীর। তিনটি বিয়ে করা জাহাঙ্গীর তৃতীয় স্ত্রী কামরুন নাহারকে নিয়ে ঢাকাতেই থাকতেন। গত মাসে জাহাঙ্গীর, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও দুই ছেলেকে নিয়ে আমেরিকায় গেছেন। ছেলেদের চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর তিনি দেশটিতে যান। মাসখানেক সেখানে অবস্থানের পর দেশে ফিরে আসেন।
জাহাঙ্গীর আলমের ভাই স্থানীয় খিলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কারও নাম বলেননি। এরপরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমার ভাইকে নিয়ে লিখছে। আমার ভাই প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন ছিলেন। কিন্তু কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না।’ আলমগীরের দাবি, জাহাঙ্গীর আলম জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় তার প্রতিপক্ষরা এসব নিউজ করাচ্ছে। তার ভাই ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীর আলমের বর্তমান অবস্থান কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাইয়ের (জাহাঙ্গীর) ছেলে ও স্ত্রী অসুস্থ। এ কারণে দেশের বাইরে গেছেন তিনি। দ্রুতই তিনি দেশে ফিরে আসবেন।’
নাম প্রকাশ না শর্তে জাহাঙ্গীরের এক আত্মীয় ঢাকা টাইমসকে বলেন, জাহাঙ্গীর দেশের বাইরেও বিপুল সম্পদ গড়েছেন। যতটুকু শোনা যায় আমেরিকায় সে বাড়ি কিনেছে। তবে সেটা কোন রাজ্যে জানা যায়নি। বছরে এক থেকে দেড় মাস সস্ত্রীক আমেরিকায় অবস্থান করেন জাহাঙ্গীর। দুই ছেলের স্কুল ছুটি হলে মূলত তারা আমেরিকায় যান। এছাড়া ঢাকা ও নোয়াখালীতে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। যা স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের নামে গড়েছেন। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেভাবে খবর প্রকাশিত হচ্ছে এবং সরকার ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে তাতে জাহাঙ্গীর দেশে ফিরবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান জাহাঙ্গীরের এই আত্মীয়।
জানা গেছে, জাহাঙ্গীরের বাড়ি চাটখিলের নাহারখিলে। তার বাবা রহমত উল্যাহ ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের একজন কেরানি। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে জাহাঙ্গীর মেজো। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ানো জাহাঙ্গীর আলম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে নোয়াখালী-১ আসন থেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হন। বিষয়টি জানার পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়, তিনি এই দপ্তরের কেউ নন। পরে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন তিনি। জাহাঙ্গীর সবসময় লাইসেন্সকৃত পিস্তল সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময়ও জাহাঙ্গীর আলম তার বাসভবন ‘সুধা সদনের’ ব্যক্তিগত স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন। সেসময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার জন্য যে খাবার পানি বাসা থেকে নেওয়া হতো, সেটা এই জাহাঙ্গীর বহন করতেন। এজন্যই তিনি ‘পানি জাহাঙ্গীর’ হিসেবে পরিচিতি পান। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে জানিয়ে রবিবার চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলতে থাকবে। আমরা এখন দুর্নীতিবাজদের ধরতে পারছি বলেই সবাই জানতে পারছে। আমার বাসায় কাজ করে গেছে, সেই পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক। সে হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। আর এটাই বাস্তব কথা।
নিজের সেই পিয়নের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যখন জানলাম সঙ্গে সঙ্গে তাকে (পিয়ন) বাসা থেকে বের করে দিয়েছি। তার কার্ড-টার্ড (পরিচয়পত্র) সব বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছি। ধরার পড়ার পরই এখন সবাই জানতে পেরেছে।’
সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়ে যাতায়াতের সুবাদে অত্যন্ত প্রতাপ দেখিয়ে চলা এই ব্যক্তি বহু অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। নানা জায়গায় হস্তক্ষেপ করে চাঁদাবাজি ও তদবিরের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। জাহাঙ্গীরচক্রে জড়িত হন আরও কয়েকজন। জাহাঙ্গীর কৌশলে চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন।
পিয়ন জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর নামে যত সম্পদ:
জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে নোয়াখালী পৌরসভার হরিনারায়ণপুর গ্রামে রয়েছে বিলাসবহুল ভবন ‘যারিয়াত ভিলা’। ৮তলা ভবনটি প্রায় ১০ শতাংশ জায়গার ওপর অবস্থিত। ভবনটির দাম প্রায় ৬ কোটি টাকা। একসময় তার শ্বশুর এ ভবনের দেখাশোনা করতেন। গত ৬ বছর আগে স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে জাহাঙ্গীর ১০ শতাংশ জায়গা কেনেন। পরে খালি জায়গা ভরাট করে ৮তলা ভবনটি তৈরি করেন।
রাজধানী ঢাকায় একাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন জাহাঙ্গীর। ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান রয়েছে তার। ঢাকার মিরপুরে একটি সাত তলা ভবন ও দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
হলফনামায় যে সম্পদের কথা বলেন জাহাঙ্গীর:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জাহাঙ্গীর কৃষি খাত থেকে তার প্রতি বছর আয় ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ, চাকরি থেকে ৬ লাখ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আয়ের তথ্য জানান। হলফনামার হিসাব অনুযায়ী বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার আয়ের কথা জানিয়েছেন।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের নিজের নামে আড়াই কোটি টাকা ও স্ত্রীর নামে ব্যাংকে প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা, ডিপিএস পৌনে তিন লাখ টাকা, এফডিআর সোয়া এক কোটি টাকা। স্ত্রীর নামে কিনেছেন গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানিতে কোটি টাকার শেয়ারও রয়েছে। এ ছাড়া একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে তার ছয় কোটি টাকার বিনিয়োগও রয়েছে।
স্ত্রী ও জাহাঙ্গীরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ:
রবিবার জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিতের (ফ্রিজ) নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ব্যাংকে এ নির্দেশনা পাঠায়। নির্দেশনায় তাদের অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য পাঁচ দিনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।
বিএফআইইউর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জাহাঙ্গীর আলম এবং তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো অ্যাকাউন্ট থাকলে ৩০ দিনের জন্য স্থগিতের (ফ্রিজ) নির্দেশনা দেওয়া হলো। এ ছাড়া এসব ব্যক্তি ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা অ্যাকাউন্টের কেওয়াইসি, হিসাব খোলার ফরম, শুরু থেকে হালনাগাদ লেনদেন বিবরণী আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে হোয়োটসঅ্যাপে ফোন করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। মেসেজ দিলেও সাড়া দেননি।
(ঢাকাটাইমস/১৫জুলাই/এসএস/ইএস)

মন্তব্য করুন