বগুড়া শজিমেক হাসপাতাল: ভোগান্তিতে আন্দোলনে আহত রোগীরা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত রোগীরা বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। তাদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করার সিদ্ধান্ত নিলেও স্যালাইন থেকে ব্যথার ওষুধ এবং অপারেশনের যাবতীয় অনুষঙ্গ রোগীদের কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে। ক্ষতস্থানে ড্রেসিং এবং ড্রেসিং করতে যাওয়ার ট্রলির জন্য প্রতিবার রোগীকে গুনতে হচ্ছে টাকা।
মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রোগীদের সেবার জন্য নার্স এবং ওয়ার্ড বয়দের একাধিকবার ডেকেও খুঁজে পান না রোগীর স্বজনরা।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব অপপ্রচার। যেসব ওষুধ হাসপাতালে নেই সেগুলো সমাজসেবার মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে বিভিন্নভাবে আহত হয়ে ৩ থেকে ৫ আগস্ট এখানে ভর্তি হয়েছিলেন ২০৯ জন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ২১ জন। অন্যরা চিকিৎসাশেষে বাড়ি গেছেন।
গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ১ দফা সরকার পতনের আন্দোলনে গিয়ে বগুড়া শহরের গালাপট্টি এলাকায় পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন শামীম আহমেদ। শহরের নারুলী এলাকার হাসমত আলী মেম্বারের ছেলে শামীম একজন মুদি দোকানি।
আহত হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে শামীম বলেন, সংঘর্ষের সময় পুলিশের টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির শব্দে তিনি নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে দৌড়ান। গালাপট্টি এলাকায় তিনি দুই দল পুলিশের মাঝখানে পড়ে গেলে একটি গলির ভেতরে আশ্রয় নেন। সেখানে পুলিশ গিয়ে তাকে ধরে ফেলে এবং লাথি মেরে ফেলে দেয়। এ সময় তিনি আকুতি জানান তাকে ছেড়ে দিতে। তাকে চলে যেতে বললে তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, কয়েক পা এগোতেই তার পা লক্ষ্য করে শটগানের গুলি করা হয়। এর পর ছোড়া হয় ছররা গুলি।
বগুড়ার ডায়াবেটিস হাসপাতালে অপারেশন করে তার পা থেকে ৩০টি ছররা গুলি ও ৫টি বুলেট বের করা হয়েছে।শামীম অভিযোগ করেন, গত ৪ আগস্ট থেকে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ডাক্তাররা ঠিকমতো তাকে দেখতে আসেননি। দু-এক দিন পর এলেও একনজর দেখে চলে গেছেন। হাসপাতালের নার্স ও ওয়ার্ড বয়রাও ঠিকমতো খোঁজখবর রাখছেন না।
বুলেটবিদ্ধ ক্ষতস্থানে ড্রেসিংয়ের জন্যও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অভিযোগ করে শামীম বলেন, ড্রেসিং করাতে তাদের পাওয়া যায় না। আবার প্রতিবার পা ড্রেসিংয়েই গুনতে হয় ১০০ টাকা। ড্রেসিংরুমে যাওয়ার জন্য প্রতিবার রোগী বহনকারী ট্রলির জন্য ওয়ার্ডবয়দের ১০০ টাকা করে দিতে হয়েছে।
৫ আগস্ট বিকেল তিনটার দিকে মিছিল নিয়ে সাতমাথা যাওয়ার সময় থানার সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হন সদর উপজেলার নুনগোলা ইউনিয়নের পল্লী কুকরুল গ্রামের সবুজ। পায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরে তিনজন পুলিশ সদস্য তাকে থানার ভেতরে নিয়ে যান। দুই ঘণ্টা থানার ভেতরে আটকে রাখা হয় তাকে। থানার বাইরে তখন অসংখ্য আন্দোলনকারী। তাকে বলা হয়, ওই সময় তাকে বের করলে থানা ভেঙে ফেলবে জনতা।
হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে সবুজ বলেন, তার পায়ে অপারেশন করে গুলি বের করা হয়েছে। অপারেশনের সময় সবকিছুই তাকে কিনতে হয়েছে। এখনো স্যালইন, ব্যথার ওষুধ সবকিছুই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।
ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ী ইউনিয়নের আব্দুল মজিদ নামে আরেক রোগী বলেন, ৪ আগস্ট আহত হন তিনি। তার শরীরে অসংখ্য বুলেট রয়েছে। শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। তিনি ডাক্তারকে বলেছিলেন অপারেশন করে বুলেটগুলো বের করার জন্য। তাকে ছয় সপ্তাহ পর হাসপাতালে যেতে বলেছে। এই মুহূর্তে নাকি তার অপারেশন করা সম্ভব নয়।
আবদুল মজিদ বলেন, তাকে যেসব ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়েছে, অধিকাংশ তাদের নিজেদের কেনা। একটি মাত্র ওষুধ দেয়া হয় হাসপাতাল থেকে।
রোগীর স্বজন ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘আমরা ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছি না। ডাক্তাররা বললে শরীরের ভেতর বিঁধে যাওয়া ছররা গুলি বের না করলেও সমস্যা নেই, আবার অনেকেই বলছে সমস্যা হতে পারে। তো আমরা সেটা কীভাবে বুঝবো। শরীরে তো প্রচুর গুলি। বিছানা থেকে নামতেও পারে না, উঠতেও পারে না। খাওয়া-দাওয়া, টয়লেট সব এখানেই। নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারছে না।’
প্রথম থেকেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন বগুড়া ফয়েজুল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মৌসুমী। আহত চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের পাশে তিনি থাকার চেষ্টা করেছেন সব সময়। প্রতিদিন তিনি হাসপাতালে গেছেন রোগীদের দেখতে।
মৌসুমী দেখেছেন, রোগীদের বেশির ভাগ ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। হাসপাতালের গোল চত্বর এবং করিডোরে ঠিকমতো ওয়ার্ডবয় ও নার্স আসেন না। বিষয়টি নিয়ে তারা নার্স ইনচার্জের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলেছেন। ওয়ার্ডের বাইরের করিডো ও গোল চত্বরে আহত অনেক রোগী রয়েছে। তাদের দেখার জন্য হাসপাতাল থেকে কেউ থাকে না।
এই হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধসহ বিভিন্নভাবে আহত হয়ে ২০৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বর্তমানে হাসপাতালে ২১ জন চিকিৎসাধীন।
রোগীরা হাসপাতাল থেকে ওষুধ পাচ্ছেন না, ড্রেসিংয়েও টাকা লাগছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে ডা. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘আমার মনে হয় এই খবরটা সঠিক নয়। হয়তো অনেকেই ভিন্নভাবে খবরটা প্রচার করছে। আমরা এই রোগীদের জন্য সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি হাসপাতাল থেকে সব ধরনের ওষুধ দেয়ার জন্য। অনেক সময় এমন হয় অনেক ওষুধ হাসপাতালে পাওয়া যায় না, যেগুলো বাইরে থেকে কিনতে হয়, সেগুলো সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। রোগী ও রোগীর স্বজনদের বলা হয়েছে এরপরেও যদি কোনো সমস্যা হয় আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে। সুতরাং যে অভিযোগটা উঠেছে আমার মনে হয় এটা অপপ্রচার বা বিভ্রান্ত ছড়ানো হচ্ছে।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের শজিমেক শাখার কর্মকর্তা মিজানুর রহমান মল্লিক বলেন, তিনি গত ১০ ও ১১ আগস্ট ওই রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের জানিয়েছেন, হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়ার পর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তাদের সব ওষুধ দেয়া হবে। ইতোমধ্যে দুজন রোগীকে ওষুধ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।(ঢাকাটাইমস/১৪আগস্ট/মোআ)

মন্তব্য করুন