বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর বন্যার কারণ ও প্রতিকার
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ অসংখ্য নদ-নদী এ দেশের ওপর দিয়ে জলের মতো প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুর কারণে প্রায় প্রতিবছরই বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই বন্যা সবদিকেই বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক ভয়াবহ দুর্যোগ ও বিপর্যয় বয়ে আনে। বিভিন্নভাবে মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কারণে বন্যার প্রভাব দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। দেশের রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম বন্যার কারণে থমকে যাচ্ছে বারবার।
বাংলাদেশে বন্যার কারণ:
বাংলাদেশে বন্যা সাধারণত বেশ কয়েকটি কারণে হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক কারণ সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে- নদীর গভীরতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদ নদী পলি ও বালি জমে জমে ভরাট হয়ে গেছে । ফলে এই সমস্ত নদীর গভীরতা কম থাকার কারণে সারা বছর নাব্য থাকে না বললেই চলে। এ কারণে নদীগুলির গতিপথ অনেকটাই মরা খালের মতো হয়ে যায়। কিন্তু বর্ষাকালে এটা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। কেননা প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাতের ফলে জমানো পানি-রাশি নদীগুলো ধারণ করতে পারে না। তখন দুই কূল উপচে পড়ে চারদিক বাসিয়ে দেয়। বর্ষা মৌসুমে নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতার বাইরে চলে গেলে নদীর দুপাশ দিয়ে পানি উপচে পড়ে এবং আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়।
বন্যা হওয়ার জন্য অতি বৃষ্টিপাত একটি বড়ো কারণ। বাংলাদেশের নদ নদীগুলোর উৎপত্তিস্থল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভারত, নেপাল, ভুটান ও ক্ষেত্র বিশেষে চীন। এই সমস্ত নদ-নদীর অববাহিকা বিশাল অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। এই অঞ্চল সমূহে যখন প্রবল বৃষ্টিপাত হয় তখন নদীতে যে পরিমাণ পানি নেমে আসে সেই পানি নদীর পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয় না। ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় পানির চাপ পড়ে এবং অকস্মাৎ বন্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে নদ-নদীর পানির স্তর বৃদ্ধি পায়। পাহাড়ি এলাকায় প্রবল বর্ষণের ফলে বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়ে। পাহাড়ের বরফ গলা পানিও বন্যার একটি অন্যতম কারণ। হিমালয়ের বরফ গলে পানি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।মানবসৃষ্ট কারণসমূহ:
বাংলাদেশে মাত্রাতিরিক্ত বনভূমির নিধন হয়ে থাকে প্রতি বছর। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ও অন্যান্য এলাকায় বনভূমি কেটে বসতি স্থাপন ও কৃষিকাজের ফলে ভূমির পানি ধারণক্ষমতা অনেক কমে যায়। এতে মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পায় এবং বৃষ্টির পানি দ্রুত নিচে নেমে আসে, যা বন্যার প্রকোপ বাড়ায়। নদী ভরাট হওয়া বন্যার একটি কারণ। দেশের নদ-নদীর তলদেশে পলি ও বালি জমে জমে নদীগুলোর গভীরতা কমে যাচ্ছে, যা পানি ধারণক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই নদীর পানি উপচে পড়ে এবং বন্যা দেখা দেয়। এছাড়া বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের অব্যবস্থাপনা অকাল বন্যা হওয়ার একটি কারণ। নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হয়। এতে বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং নিকটবর্তী এলাকার জনগণের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়।
বন্যার সমস্যা:
বন্যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে। এসব সমস্যা পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
আর্থ-সামাজিক সমস্যা:
বন্যার কারণে ফসলি জমি প্লাবিত হয়ে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে দেশের কৃষকরা তাদের জীবিকা হারায়। বিশেষ করে ধান, পাট ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের ক্ষতি হওয়ায় খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এছাড়া গবাদিপশুর মৃত্যু ও আশ্রয়হীনতার সমস্যাও দেখা দেয়। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদী হয়ে থাকে। পুকুরে মাছ চাষ করে অনেক মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে থাকে। অনেকের এটাই একমাত্র পেশা হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু বন্যার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সকল চাষকৃত মাছ বন্যার জলে ভেসে যায়। এবার ২০২৪-এর বন্যায় শত শত কোটি টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বলে সংবাদমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি।
মানুষের দুর্ভোগ:
বন্যার কারণে গ্রামের বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। তাদের অনেকে আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে বাধ্য হয়। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, চর্মরোগ ও হেপাটাইটিসসহ পানিবাহিত রোগগুলোর প্রকোপ বৃদ্ধি পায় এ সময়।
পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া:
বন্যায় রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়ে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। এতে জরুরি সেবা পৌঁছানো এবং ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে যথেষ্ট সমস্যা হয়।
পরিবেশগত সমস্যা:
বন্যার ফলে মাটির উর্বরতা একদিকে বৃদ্ধি পায় ঠিকই। তবে একই সঙ্গে ভূমির ক্ষয় ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য নদীর পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। বন্যার পর প্লাবিত এলাকায় মাটির গুণগত মান কমে যায়, যা পরবর্তী সময়ে কৃষিকাজে বাধা সৃষ্টি করে।
বন্যা প্রতিরোধের উপায়সমূহ:
বন্যা প্রতিরোধের জন্য কিছু প্রাকৃতিক ও কারিগরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদিও সম্পূর্ণভাবে বন্যা রোধ করা সম্ভব নয়। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো যেতে পারে। নদী ব্যবস্থাপনা ও পলি অপসারণ করে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব অনেকটা। নদীগুলোর নিয়মিত ড্রেজিং বা পলি অপসারণের মাধ্যমে পানি প্রবাহের সঠিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। এতে নদীর গভীরতা বজায় থাকবে এবং অতিরিক্ত পানি সহজেই প্রবাহিত হতে পারবে। দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য খাল এবং নালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এক সময় এই খাল ও নালাগুলোর উপরে কাঠের সেতু কিংবা পাকা সেতু ছিল। এ সমস্ত নালা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অঞ্চলভিত্তিক পানি সরে বড়ো নদীতে পড়তে বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। এছাড়া অসংখ্য খাল ও খালের পাড় দখল করে মানুষ সেখানে বাণিজ্যকেন্দ্র কিংবা বসতি স্থাপন করেছে। এদের কাছ থেকে খাল উদ্ধার করে সঠিকভাবে খনন করে যদি পানি প্রবাহ তৈরি করা যায় তাহলে বন্যার বিপরীতে একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।
বাঁধ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নতি:
নদীগুলোর আশেপাশে পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে বন্যার ক্ষতি কমানো সম্ভব। তবে এতে প্রকৃতির স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। উঁচু জায়গাগুলোতে বনায়ন কর্মসূচি বাড়তে হবে। বন্যারোধে পার্বত্য ও নদী অববাহিকায় বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এতে মাটির ক্ষয়রোধ হবে এবং পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়বে। এভাবে বন্যার ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব।
আধুনিক পূর্বাভাস প্রযুক্তি:
দেশে বন্যার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সাহায্যে বন্যার আগে সতর্কবার্তা প্রদান করা গেলে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। বন্যার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার আগেই সাধারণ মানুষকে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কাজও করতে হবে। যদিও বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এর মধ্যেও কিছু সম্ভাবনা রয়েছে যা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো যেতে পারে।
প্রাকৃতিক বন্যায় কিছু কিছু ভালো দিকও আছে, আর তাহলো মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় বন্যার সময় পানি বৃদ্ধি হওয়ার ফলে। বন্যার ফলে নদীগুলোর মাধ্যমে প্লাবিত জমিতে পলি জমা হয়, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। ফলে বন্যার পর ফসল ফলানোর জন্য জমি বেশি উপযোগী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রবিশস্য উৎপাদনে এটি অত্যন্ত সহায়ক।
বন্যার ফলে মৎসচাষীদের একদিকে মৎস্য উৎপাদন ধ্বংস হয়ে যায়- এটা ঠিক; অন্যদিকে বন্যার ফলে বিভিন্ন জলাশয় ও নদীতে মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ সময় বিশেষ করে দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদনের হার বেড়ে যায়, যা দেশের মৎস্য সম্পদের জন্য মন্দের ভালো হলেও একটি ইতিবাচক দিক।
জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন ঘটে বন্যার ফলে। বন্যার সময় নতুন জলাভূমি ও জলাশয়ের সৃষ্টি হয়, যা বিভিন্ন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের পরিবেশে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির পুনর্জন্ম ঘটে, যা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়া অস্বীকার যাবে না কোনোমতেই যে- ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পূরণ হয় বন্যার ফলে। বন্যার পানি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পূরণ করতে সহায়তা করে। এতে শুকনো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বজায় থাকে, যা কৃষিকাজ ও দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বন্যার সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বন্যার প্রতিকার এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের বন্যা সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। বন্যার সময় যাতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয় সেজন্য টেকসই অবকাঠামো তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে বাড়িঘর, রাস্তা ও ব্রিজগুলোকে বন্যা প্রতিরোধী করে তৈরি করতে হবে। বন্যা সহনশীল ফসলের চাষ বাড়াতে হবে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যা সহনশীল ফসলের চাষাবাদ বাড়াতে কৃষি অধিদপ্তরের কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে কিছু বন্যা প্রতিরোধী ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা বন্যা পরিস্থিতিতেও ভালো ফলন দিতে সক্ষম। বন্যায় ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রমে আধুনিকায়ন আনতে হবে। বন্যাকালীন ও বন্যা পরবর্তী সময়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় আরও সমন্বিত ও দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিকল্প নেই। বিশেষ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষিত লোকবল ও আধুনিক সরঞ্জাম নিশ্চিত করা জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবিলায় সরকারের কার্যকরী উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের আবাসন, ফসল, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যরক্ষাসহ নানাবিধ বিষয়ে সময়োপযোগী সচেতনতা তৈরি করতে হবে।মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন: কলাম লেখক ও সাবেক কলেজ শিক্ষক