সরকারি চাকরিতে যৌক্তিকভাবেই বয়সসীমা বাড়ানো প্রয়োজন

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন
  প্রকাশিত : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০১
অ- অ+

একটি নির্দিষ্ট পরিসর পর্যন্ত পড়াশোনা শেষে প্রত্যেক মানুষকে একটি পেশা বেছে নিতেই হয়। মানুষের স্বাধীনতা রয়েছে তার যোগ্যতা এবং ইচ্ছা অনুযায়ী একটি পেশা বেছে নেওয়ার। এ পেশা হতে পারে তার ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় অথবা বেসরকারি কোনো কোম্পানি কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানে একটি কাজ নেওয়া। বাংলাদেশের যেহেতু কাজের তুলনায় কর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি তাই যোগ্যতা ও চাহিদা অনুযায়ী একটি কাজ পাওয়া এই দেশে সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার সমতুল্য। এ কারণে অনেক মানুষই যোগ্যতা এবং ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশে কোনো ভালো কাজ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দেশের বাইরে চলে যান। তবে এটা সবার অনুকূলে নয় বিধায় অনেকেই চান যে তার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ হোক বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের নানান সীমাবদ্ধতা থাকায় মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এখানে পদের চেয়ে আবেদনকারী বেশি। দেখা গেছে পদ রয়েছে পনেরো’শ অথচ প্রার্থী আছে ৩ থেকে ৪ লাখ।

পত্রিকায় প্রকাশিত ভাষ্যমতে, ৪১তম বিসিএসে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী আবেদন করেছেন। এই বিসিএস-এ মোট ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থীর আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। এতে বিভিন্ন পদে ২ হাজার ১৩৫ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে ৪০তম বিসিএসে রেকর্ডসংখ্যক ৪ লাখ ১২ হাজার প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সূত্র মতে, মোট ৪ লাখ ৭৫ হাজার আবেদন জমা পড়েছে, যা রেকর্ড পরিমাণ।

পিএসসি সূত্র জানা যায়, ২০১৮ সালে ৪০তম বিসিএসে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। ঐ বছর ৪ লাখ ১২ হাজার প্রার্থী আবেদন করেন। বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ও অবসরের বয়স নিয়ে বর্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক ও আন্দোলন চলমান রয়েছে। এক সময় বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর এবং অবসরের বয়স ছিল ৫৭ বছর। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে হয়তো এটি ছিল যথাযথ, কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই নীতি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর এবং অবসরের বয়স ৫৯ বছর করা হয়। যদিও এটি ছিল সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ, তবুও অনেকেই মনে করেন যে- এই পরিবর্তন যথেষ্ট নয়।

সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করার ফলে, অবসরের বয়সও সমানভাবে বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন অনেকে। কারণ পূর্বে একজন চাকরিজীবী সর্বনিম্ন ৩০ বছর কাজ করতে পারতেন, কিন্তু বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ এবং অবসরের বয়স ৫৯ করায় একজন কর্মী সর্বোচ্চ ২৯ বছর কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ, এক বছর কম কাজ করার সুযোগ থাকছে। এ পরিস্থিতি অনেকের জন্যই অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি, হয়তো এ সমস্যাটি আগে কারও নজরেও আসেনি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসা খুবই দরকার।

তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে আরও বৃদ্ধি করে ৩৫ করার দাবি উঠেছে বেশ আগে থেকেই। এ দাবি যথেষ্ট যৌক্তিক এবং সময়ের প্রয়োজনে এটি গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। বর্তমান সময়ের বাস্তবতাও এমন যে, চাকরিতে প্রবেশের এবং অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা একান্তই প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হচ্ছে। দেখা গেছে অনেকেই সঠিক সময়ে নানান কারণে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারে না। উচ্চশিক্ষায় প্রতিযোগিতাও বেড়েছে অনেক; এটা নিশ্চয়ই ইতিবাচক বিষয়। যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছে না। ফলে একটি সেশন বাদ দিয়ে অনেককেই পরের সেশনে ভর্তি হতে হচ্ছে। এভাবেই জীবন থেকে চলে যাচ্ছে মূল্যবান সময়। সুতরাং, বয়সসীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ আরও সহজ করা উচিত। তরুণ চাকরিপ্রার্থীদেরকে অন্তত প্রতিযোগিতায় নেমে কাক্সিক্ষত চাকুরি প্রাপ্তির চেষ্টা করার সুযোগটা দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশ থেকে ধীরে ধীরে উন্নত রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উন্নত বাংলাদেশ ধারণাটি এখন আর কেবল কল্পনায় সীমাবদ্ধ নয়; তা বাস্তবতাতেও রূপ নিয়েছে। আমাদের মাতৃভূমি এখন আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কিংবা অবসরের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। মানুষ তাদের দক্ষতা ও শারীরিক সামর্থ্যরে ভিত্তিতে চাকরি করতে পারে এবং এভাবেই তারা তাদের জীবন পরিচালনা করে থাকে। ঐ দেশগুলোতে কাজের জন্য বয়সের মেয়াদ নির্ধারিত না থাকায়, একজন কর্মী যতদিন চাইবেন ততদিন কাজ করতে পারেন এবং রাষ্ট্রকে ট্যাক্স প্রদান করেন। এই ধরনের পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

একটি আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাজে প্রবেশের বয়সসীমা সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশে কাজের বয়সের সীমাবদ্ধতা থাকাটা অনাকাঙ্ক্ষিত। যদি অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে চাকরির বয়সসীমা না থাকে, তাহলে আমাদের দেশেও বয়সের এই নিয়ম থাকা উচিত নয়। বাংলাদেশ এখন যে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ও তাদের কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে চাকরিতে অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা ও খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।

গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বর্তমান পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু এবং কর্মক্ষমতা উভয়ই বেড়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এখন দেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর, যা কয়েক বছর আগেও ৭০ বছরের অনেক নিচে ছিল। এই আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের কর্মক্ষমতার বয়সও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বর্ধিত বয়সে তার বেঁচে থাকার জন্য নানান চাহিদা মেটানোর জন্য তাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। ফলে চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। বর্তমান বাস্তবতায়, অবসর গ্রহণের বয়সসীমা কমপক্ষে ৬৫ বছর করা যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। এতে অনেক সরকারি চাকরিজীবী উপকৃত হবেন এবং তারা আরও কয়েক বছর কর্মমুখী জীবনযাপন করতে পারবেন। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং উচ্চ আদালতে অবসরের বয়সসীমা যথাক্রমে ৬৫ এবং ৬৭ বছর বলে জানা গেছে। সুতরাং সরকারি চাকরিতে অবসরের ন্যূনতম বয়সসীমা অন্তত ৬৫ বছর করা এখন সময়ের দাবি এবং বাস্তবতার নিরিখে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।

একজন কর্মী যখন অবসরে যান, তখন তার সামনে আর কোনো কাজ থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ান। কেননা তখন তাদের আয়রোজগার থাকে না বললেই চলে। অথচ খরচ থাকে অনেক। জীবনের শেষ অধ্যায়ে তাদের জন্য অর্থনৈতিক সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে, অবসর নেওয়ার পর সীমিত আয়ের কারণে তাদের জীবনে হতাশা ও মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। সেই প্রেক্ষাপটে, অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মজীবীদের জন্য একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে। এছাড়া, অবসর গ্রহণের পর কর্মীরা সামাজিকভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে পারেন। কাজের সুযোগ আরও দীর্ঘ হলে তারা সামাজিক জীবনের সাথে যুক্ত থাকতে পারেন এবং মানসিকভাবেও সুস্থ থাকতে পারেন। অবসর গ্রহণের বয়স বৃদ্ধি করলে একজন কর্মীকে আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব হবে এবং তাদের জীবনের শেষ পর্যায়টিও আরও সুন্দর ও সুরক্ষিত হবে।

এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর জন্য সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। জনমত গড়ে তোলার মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা করা উচিত। চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়সসীমা সম্পর্কে একটি সঠিক ও সময়োপযোগী নীতি প্রণয়ন করা জরুরি, যাতে কর্মজীবীরা আরও আর্থিক এবং সামাজিক সুরক্ষা পান। অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব এবং এটি সরকারের পক্ষ থেকে একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হবে বলে মনে করি।

বর্তমান বাস্তবতায়, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ও অবসরের বয়স নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে নীতিমালা পরিবর্তন করে সরকারি কর্মজীবীদের জন্য আরও দীর্ঘস্থায়ী কর্মজীবন এবং অবসরের পরও মানসিক ও অর্থনৈতিক স্বস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। এজন্য একটি শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা আমাদের দেশকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি বেশ পুরোনো হলেও শেষ পর্যন্ত যে চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ছে- এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। বাড়ানো হচ্ছে অবসরে যাওয়ার সময়সীমাও। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এখন কাজ চলছে। সরকারি চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে এ বিষয়ক বিধি-বিধান কোথায়, কী সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স যথাক্রমে ৩৫ ও ৬৫ নির্ধারণ করার দাবি উঠলেও মানুষের গড় আয়ু বিবেচনায় নিয়ে বয়সসীমা চূড়ান্ত হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে চাকরিতে আবেদনের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৩২ এবং অবসরের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৬২ নির্ধারণ করা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে সরকার এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি বটে তবে সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে। চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স বাড়াতে সুপারিশ করবে কি না, তা এ কমিশনেরই এখতিয়ারভুক্ত। সব মিলিয়ে এই অন্তর্বতীকালীন সরকার যদি চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী তাদের চাকরিপ্রাপ্তির এবং অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেয় তাহলে এই কাজটি হবে খুবই ইতিবাচক। অতীতের দলীয় সরকারগুলো যা করতে পারেনি এই সরকার সেটাই করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন: কলাম লেখক, সাবেক কলেজ শিক্ষক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মানিকগঞ্জের সাবেক এমপি মমতাজ গ্রেপ্তার
কুষ্টিয়া-মেহেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে অনিয়মের প্রমাণ পেল দুদক
কোতয়ালী এলাকায় বিশেষ অভিযান, মাদক কারবারিসহ গ্রেপ্তার ১৫
ফরিদপুরে মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা