নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস আজ, গর্ভবতী মায়ের যত্নে করণীয়

আজ ২৮ মে, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। মাতৃত্ব একজন নারীর সবচেয়ে বড় সার্থকতা। কিন্তু একজন নারী যখন প্রথমবার গর্ভধারণ করেন তখন অনেক কিছুই তার অজানা থাকে। তাই সন্তান ধারণ থেকে শুরু করে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত একজন মা’কে অনেক বিষয়ে সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হয়। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও দিবসটি উপলক্ষে মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছর নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মাতৃস্বাস্থ্যে সমতা; বাদ যাবে না কোনো মা’।
নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা হলো নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালনের উদ্দেশ্য। একজন নারী গর্ভধারণের পর থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রাখেন।
শুধু মা-ই নন, মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুরও যত্ন প্রয়োজন, যাকে বলা হয় গর্ভকালীন সেবা।
এই গর্ভকালীন যত্নের লক্ষ্য হলো মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গর্ভজনিত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা। এক কথায় মায়ের স্বাস্থ্যের কোনো অবনতি না করে পরিবার, সমাজ ও দেশকে একটি সুস্থ শিশু উপহার দেওয়া।
১৯৯৭ সাল থেকে ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করে আসছে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ উদ্যোগ টেকসই উন্নয়নের অন্তর্ভুক্ত করে। নিরাপদ মাতৃত্বের কার্যক্রম পরিচালনা করে সরকার, বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন। এসব কার্যক্রমের ফলে মাতৃমৃত্যুর হার কমে এসেছে।
জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, শিশু জন্ম দিতে গিয়ে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারী মারা যান। আর অন্তত পক্ষে সাত মিলিয়ন নারী প্রসব পরবর্তী গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এছাড়া প্রসবের পর নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভোগেন আরও ৫০ মিলিয়ন নারী।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ১২ হাজার নারী গর্ভধারণ ও গর্ভধারণ সংক্রান্ত কারণে মারা যান বলে জানায় ডব্লিউএইচও। আমাদের দেশে প্রতি এক লাখ প্রসবের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ১৬৫ জন। ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নে এ সংখ্যা ৭০ জনে কমিয়ে আনতে হবে।
গর্ভবতী মায়ের খাওয়া দাওয়া এবং মানসিক ও শারীরিক যত্ন
শিশু গর্ভে থাকাকালীন তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠিত হয়। তাই এসময় মায়ের খাদ্যের উপর বিশেষ যত্ন নিতে হবে। মায়ের খাওয়া খাদ্য প্লাসেন্টা’র মাধ্যমে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে।
তাই মা যা খাচ্ছে সেটি মা-শিশু উভয়ের জন্যই পর্যাপ্ত পুষ্টির জোগান দিচ্ছে কিনা, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অন্যদিকে মা যদি অসুস্থ হয় বা যদি কোনো বিষয়ে মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন থাকে, সেটিও উভয়ের জন্য সমান ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই গর্ভকালীন একজন মায়ের সমানভাবে শারীরিক ও মানসিক যত্ন নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। মানসিক চাপমুক্ত থাকা, ভারী কোন ওজন না নেওয়া, উঁচুনিচু স্থান এড়িয়ে চলা, ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
পরিকল্পিত গর্ভধারণ মা ও শিশু উভয়ের জন্যই অত্যন্ত নিরাপদ। সন্তান ধারণের আগে মায়ের ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি শারীরিক পরীক্ষা করে নেওয়া প্রয়োজন। সেইসাথে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সন্তান ধারণের তিন মাস আগ থেকে নিয়মিত ফলিক অ্যাসিডসহ অন্যান্য ওষুধ সেবনের প্রয়োজনও হতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের পোশাক নিয়েও সচেতন থাকা উচিৎ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক, সহজে পরিধানযোগ্য ও ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান এবং সঠিক মাপের নরম জুতা পরা এবং উঁচু বা হিল জুতা পরিহার করাই শ্রেয়।
একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রায় প্রতি মাসেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি তথ্য অনুযায়ী, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে অবশ্যই কমপক্ষে চারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এই চারবার হচ্ছে যথাক্রমে ১৬, ২৮, ৩২ ও ৩৬তম সপ্তাহে। এছাড়া কারও শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
একজন প্রসুতি মায়ের জন্য গর্ভধারণকালীন প্রথম এবং শেষ তিনমাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু গর্ভে থাকার প্রথম তিন মাসেই তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো পূর্ণ রূপ ধারণ করে। গর্ভাবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়েদের হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পড়ে যায়। কারণ এ সময় গর্ভস্থ শিশুর শরীরে লৌহের চাহিদা মেটানোর পর মায়েদের রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এজন্য গর্ভবতী মাকে এসময় প্রয়োজনীয় ওষুধের পাশাপাশি সবুজ শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
গর্ভে থাকাকালীন শেষ তিন মাস শিশু খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। যে কারণে প্রসূতি মায়ের পায়ে পানি আসতে পারে। এছাড়া শেষ তিন মাসে পেট বড় হয়ে যাওয়ার কারণে গর্ভবতী মায়ের অনেক কষ্ট হয়। এই সময়ে কিছু জটিলতাও দেখা দিতে পারে, যেমন অস্বাভাবিক পেট বড় বা ছোট হওয়া, হঠাৎ রক্ত ভাঙা, খুব বেশি জ্বর আসা, রক্তচাপ অতিরিক্ত বেশি হওয়া। এমন পরিস্থিতিতে অনতিবিলম্বে চিকিৎসককে দেখাতে হবে।
চিকিৎসকের মতে, রক্ত জমাট বাঁধার জন্য ভিটামিন কে অপরিহার্য, যা প্রসবের পর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই থার্ড ট্রাইমেস্টারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। যাতে সন্তান জন্মদানের সময় এই ভিটামিনের ঘাটতি না হয়।
ফার্স্ট এবং সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের মতো রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করার জন্য আপনার থার্ড ট্রাইমেস্টারেও আয়রন একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। আপনি যদি রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত হন এবং এই অবস্থার চিকিৎসা না করা হয় তাহলে সময়ের আগেই প্রসব হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে শিশুর ওজন দ্রুত বাড়তে থাকে। এজন্য এই সময়ে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। ফার্স্ট ও সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারের তুলনায় এ সময় ক্যালরি চাহিদাও কিছুটা বেড়ে যায়। তাই এ সময় অন্তত ৪০০ ক্যালরি অতিরিক্ত গ্রহণ করতে হবে।
চর্বি ও অন্যান্য যেসব খাবার দ্রুত ওজন বাড়ায় সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। এই সময় ডাক্তার মা ও শিশুর ওজনের ওপর ভিত্তি করে ডায়েট গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যদি শিশুর ওজন প্রয়োজনের চেয়ে কম হয় তাহলে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
শেষ ৩ মাসের খাদ্য তালিকা
এই সময়টাতে শিশুর ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পুষ্টির চাহিদা বেড়ে যায়। আর এজন্য গর্ভবতী মাকে এ সময় অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
থার্ড ট্রাইমেস্টারে রক্তস্বল্পতা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বেশি বেশি আয়রনযুক্ত খাবার খেতে হবে। বাদাম, কলা, ডাবের পানি, পালং শাক, মটরশুঁটি, মসুর ডাল, সবুজ শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে। সর্বাধিক পরিমাণে আয়রন শোষণে প্রয়োজন ভিটামিন সি। সাইট্রাস ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে।
এ সময় ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডির চাহিদা বেড়ে যায়। ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার যেমন- ডিমের কুসুম, গরু ও খাসির কলিজা, মাশরুম, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। সেইসঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়াও প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৩টার মধ্যে অন্তত ১০ থেকে ১৫ মিনিট গায়ে রোদ লাগাতে হবে৷
শিশুর হাড়কে মজবুত করার জন্য প্রয়োজন ক্যালসিয়াম। ডেইরি মিল্ক, ব্রকলি, বাদাম, দই ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে যা গর্ভবতী মায়েদের ক্যালসিয়ামের যোগান দিতে পারে।
এ সময়ে প্রয়োজন বাড়তি ক্যালরি। কিসমিস, খেজুর ইত্যাদি শুকনো ফল যোগান দেবে বাড়তি ক্যালরির।
মাছ, ডিম, ডাল ও অন্যান্য প্রোটিন জাতীয় খাবার কতটুকু পরিমাণে খেতে হবে সেটা নির্ভর করবে শিশুর ওজনের ওপর। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর ওজন জানার পর প্রোটিন জাতীয় খাবার কতটুকু পরিমাণে খেতে হবে সেটা নির্ধারণ করে দেবেন।
এ সময় খেতে হবে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার। ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করবে। বাদামি চাল, শাকসবজি, মটরশুটি, নারিকেল, কাজু বাদাম, চিনাবাদাম ইত্যাদি খাবারে ফাইবার আছে।
এ সময়ে বাড়তি পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় যেসব খাবার এড়িয়ে চলা উচিত
কাঁচা বা আধাসেদ্ধ শাকসবজি গর্ভাবস্থায় খাওয়া উচিত নয়। খাবারের কারণে বদহজম যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অবশ্যই শাকসবজি খেতে হবে কিন্তু সেটা তাজা ও ভালোভাবে রান্না করা হতে হবে।
যেহেতু গর্ভাবস্থায় বিশেষ করে থার্ড ট্রাইমেস্টারে উচ্চ রক্তচাপের একটা ঝুঁকি থাকে তাই খুব বেশি লবণ খাওয়া যাবে না। তাছাড়া লবণ ও অন্যান্য লবণযুক্ত খাবার বেশি খাওয়ার ফলে পায়ে পানি আসতে পারে।
এ সময় ঝাল, ঝাঁঝালো, তৈলাক্ত ও ক্যাফেইন জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত নয়।
গর্ভাবস্থায় উচ্চ শর্করা জাতীয় খাবার না খাওয়াই ভালো। কারণ গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। তাই মিষ্টি, মিষ্টি জাতীয় খাবার অথবা উচ্চ শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত নয়।
প্রতিটি মানুষের শরীর আলাদা ধরনের। নারীদের গর্ভধারণের পর খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেবেন।
(ঢাকাটাইমস/২৮ মে/আরজেড)

মন্তব্য করুন