সুপারফুড ভুট্টা কিডনি-ডায়াবেটিসের মহৌষধ, রোগ থাকে দূরে
প্রাচীন যুগ থেকে মানুষের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের প্রচেষ্টা যেন নিরন্তর। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অপুষ্টি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে, এবং অসংক্রামক রোগব্যাধি যেমন বহুমূত্র রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। ভুট্টা এমনই একটি স্বাস্থ্যকর খাবার যা বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে বিশেষ কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে এবং প্রোটিনের গুণমানের জন্য ‘দানাশস্যের রানি’ হিসেবে পরিচিত। ভুট্টার আদি উৎপত্তিস্থল হচ্ছে মেসো আমেরিকা। ইউরোপীয়রা আমেরিকা মহাদেশে পদার্পণ করার পর বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ভুট্টা। বাংলাদেশে দানাশস্যের মধ্যে ধান ও গমের পরেই রয়েছে ভুট্টার অবস্থান।
ভুট্টা বা কর্ন একপ্রকারের অধিক ফলনশীল খাদ্যশস্য। অনেক দেশে মেইজও বলা হয়। বৈজ্ঞানিক ভাষায় ভুট্টাকে জেয়া মেইজ নামে ডাকা হয়। ভুট্টা একটি সুস্বাদু খাবার যা এর মিষ্টি স্বাদ, উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ।
ভুট্টার খই বা পপর্কন খেতে ভালবাসেন প্রচুর মানুষ। তবে এটা যে শুধু খেতে ভাল তাই নয়, এর অনেক উপকারিতাও আছে। আর ভুট্টা দিয়ে যে শুধু পপকর্ন তৈরি হয় তাই নয়, টর্টিলা চিপস, কর্নমিল, কর্ণ ফ্লাওয়ার, কর্ন সিরাপ এবং কর্ন অয়েলের মতো আরও অনেক কিছু সামগ্রীও তৈরি হয় এর থেকে।
ভুট্টাকে বলা হয় পুরো পুষ্টির ভান্ডার। ১০০ গ্রাম সিদ্ধ ভুট্টায় ৯৬ ক্যালোরি, ৭৩% জল, ৩.৪ প্রোটিন, ২১ গ্রাম কার্বস, ৪.৫ গ্রাম চিনি, ২.৪ ফাইবার এবং ১.৬ ফ্যাট থাকে। এতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুবই কম পরিমানে থাকে। ১১২ গ্রাম পপকর্নে ১৬ গ্রাম ফাইবার থাকে। তাছাড়াও এতে পর্যাপ্ত পরিমানে ভিটামিন ই থাকে। কোলেস্টেরলের মাত্রাও এতে খুব কম থাকে।
ভুট্টায় ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ফাইবারসহ অনেক প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ আছে। যার ফলে শরীরে পুষ্টি বৃদ্ধি পায়। এর পাশাপাশি এটি ত্বক, চুল এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনেক সমস্যায় ম্যাজিকের মতো কাজ করে। এই কারণে একে সুপারফুড এর তালিকায় ফেলা হয়েছে।
ভুট্টা থেকে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর আলাদা আলাদা ভিটামিন ও পুষ্টিগুণ থাকে। যেমন পপকর্নে খনিজ ও সুইট কর্নে বেশকিছু ভিটামিন থাকে। ভুট্টা ও পপকর্নে প্রচুর পরিমাণ ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ ও জিঙ্ক পাওয়া যায়। অন্যদিকে সুইট কর্নে ভিটামিন বি৫ ও বি৯ পাওয়া যায়। এটা শরীরে ফলিক অ্যাডিডের ঘাটতি পূরণ করে।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে সপ্তাহে ৩-৪ দিন ভুট্টা খেলে শরীরের একাধিক উপকার হয়ে থাকে। কারণ এই প্রাকৃতিক উপাদানটির শরীরে ঠাসা রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ভিটামিন এ, বি, ই সহ নানাবিধ পুষ্টিকর উপাদান। সেই সঙ্গে রয়েছে ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসহ আরও সব উপকারি মিনারেল, যা নানাভাবে শরীরের উপকারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। জেনে নিন ভুট্টার স্বাস্থ্য উপকারিতা-
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত ভুট্টা খাওয়া শুরু করলে দেহের অন্দরে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা যায় কমে। শুধু তাই নয়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমে। যাদের পরিবারে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের ইতিহাস রয়েছে, তারা প্রতিদিনের ডায়েটে এই প্রাকৃতিক উপাদানটিকে রাখতে ভুলবেন না যেন!
কিডনির সমস্যায়
ভুট্টা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ও কিডনির সমস্যাযর ক্ষেত্রেও উপকারি। মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পরিমাণ বুঝে ভুট্টা খাওয়া উচিত। তবে যুবকরা প্রতিদিনই ভুট্টা খেতে পারেন।
শরীর এবং মস্তিষ্কে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি
ভুট্টায় উপস্থিত ভিটামিন বি, থিয়ামিন এবং নিয়াসিন ব্রেন পাওয়ার বাড়ানোর পাশাপাশি ব্রেন সেলের গ্রোথেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই তো এই প্রাকৃতিক উপাদানটি নিয়মিত খাওয়ার অভ্য়াস করলে কোনও ধরনের ব্রেন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারে কমে যায়। শুধু তাই নয়, এই পুষ্টিকর উপাদানগুলো শরীরকে ভিতর থেকে শক্তিশালী করে তুলতেও সাহায্য করে। তাই তো নিয়িমত ভুট্টা খেলে শরীর এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও চিন্তাই থাকে না।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে
এলডিএল নামে শরীরে যে খারাপ কোলেস্টেরল থাকে, ভুট্টা তা দূর করতে সাহায্য করে। ভুট্টায় থাকা ভিটামিন এ দৃষ্টি শক্তি প্রখর করতে সাহায্য করে।
ওজন কমাতে
যারা ওজন বেড়ে যাবে বলে অনেক খাবার বাদ দেই তাদের জন্য ভুট্টা কিন্তু টপ চয়েস হতে পারে। প্রতিদিন ভুট্টা খেলে ওজন বেড়ে যাবার ভয় নেই। চাইলে ভুট্টা মাইক্রোওয়েভে গ্রিল করে খেতে পারেন। ভুট্টায় আছে বা বায়োফ্লাভোনয়েডস এবং ক্যারোটিনয়েডসের মতো প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে যা শরীরকে সুস্থ রাখে।
ত্বকের সমস্যায়
ভুট্টাতে থাকা ভিটামিন সি, এ, ও লাইকোপিন ত্বককে উজ্জ্বল রাখে এবং ত্বকের সমস্যা দূরে রাখে।
চোখের উপকারে
ভুট্টায় ক্যারোটিনয়েড লুটিন এবং জেক্সানথিনের মতো প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এটি অপটিক টিস্যু থেকে ক্ষতিকারক ফ্রি রেডিক্যালস দূর করে এবং দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। পাশাপাশি চোখের সূক্ষ্ম অংশগুলিকেও ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায়। গ্লুকোমা এবং ছানির মতো সমস্যা থেকেও রক্ষা করে।
সর্দি-কাশি থেকে বাঁচতে
ঋতুবদলের এই সময়ে সর্দি-কাশি দেখা দেওয়া স্বাভাবিক বিষয়। ভুট্টায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় কফ এবং পিত্ত নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এটি কাশি এবং সর্দি থেকে রক্ষা করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
ভুট্টার উপস্থিত ফাইবার শরীরে প্রবেশ করার পর একদিকে যেমন পাকস্থলির কর্মক্ষমতা বাড়ায়, তেমনি শরীরের বর্জ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য মতো সমস্যা কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই সঙ্গে বদ-হজমের প্রকোপ কমাতেও বিশেষ ভূমিকা নেয়।
রক্তাল্পতা দূর করতে
যাদের রক্তে হিমগ্লোবিনের মাত্রা কম তাদের জন্য এটি ওষুধের মতো কাজ করে। তাই রক্তাল্পতার চিকিৎসায় ভুট্টা খুবই সহায়ক।
হার্টের সুরক্ষায়
ভুট্টায় কোলেস্টেরলের এবং সোডিয়াম খাকে না। এতে থাকা ফাইবার ও ভিটামিন B3 থাকে সেটি ভালো কোলেস্টেরল বাড়ায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল কমায়। ভুট্টার আটায় তৈরি রুটি হার্টের রোগীদের জন্য খুবই উপকারি।
অ্যানিমিয়া দূর করে
শরীরে আয়রনের ঘাটতি দূর করার পাশাপাশি লহিত রক্ত কণিকার উত্পাদন বাড়িয়ে অ্যানিমিয়া রোগের প্রকোপ কমাতে ভুট্টা বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই সঙ্গে কোষের গঠনেও সাহায্য করে। তাই এর পর থেকে কোনও সময় যদি রক্তাল্পতার মতো সমস্যায় আক্রান্ত হন, তাহলে ভুট্টা খেতে ভুলবেন না যেন!
বার্ধক্য রোধ করতে
ভুট্টা খেলে শরীরে কোলাজেন তৈরি হয়, যার কারণে ত্বক নরম ও মসৃণ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি ভুট্টার বীজে থাকা ভুফেনোলিক অ্যাসিড এবং ফ্লেভোনয়েড, এই দুই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফ্রি রেডিক্যালসের সমস্যা দূর। ত্বকের নতুন কোষ তৈরির পাশাপাশি বলি রেখা মেটায়।
গর্ভাবস্থায় উপকারী
গর্ভাবস্থায় খাদ্য হিসেবে ভুট্টা গ্রহণকে খুবই উপকারী বলে মনে করা হয়। কারণ ভুট্টায় রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রণ, এবং ফলিক অ্যাসিড সহ ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি ইত্যাদি। আর এইসব পৌষ্টিক উপাদান গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী।
(ঢাকাটাইমস/২৭ নভেম্বর/আরজেড)
মন্তব্য করুন