থেমে গেছে তদন্ত, স্বজনরাও জানতে চায় ‘আনার জীবিত নাকি মৃত’
ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিখোঁজ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের রহস্য এখনো মীমাংসা হয়নি। তার খোঁজে তদন্ত করতে যে মানব মাংসের টুকরা বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে, তা আনারের কি না সেটিও কোনো কর্তৃপক্ষের তরফে স্বীকৃত হয়নি। নিখোঁজের প্রায় সাড়ে ছয় মাসের মাথায় এসে থেমে আছে মামলার তদন্তও।
আনারের স্বজনরা বলছেন, গত আগস্টে সরকার পতনের পর আনার ইস্যুতে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এখনো তারা ধোঁয়াশায়- আনার জীবিত, নাকি মৃত।
এই প্রশ্নে জবাব পেতে প্রয়োজন ডিএনএ পরীক্ষা। সেটি করা গেলে ভারতে সঞ্জিবা গার্ডেনের ম্যানহোলে পাওয়া মানুষের শরীরের মাংসের খণ্ড আওয়ামী লীগের এই নেতার কি না তা জানা যেত। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা দেওয়ার জন্য তার ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের ভারতে যাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি ভারতে যেতে একরকম অনীহ। তার ভারতে না যাওয়া নিয়ে আছে নানা গুঞ্জন।
এখন পুলিশও এই ইস্যুতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে জানা যাচ্ছে। আনার নিখোঁজের ঘটনায় রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানায় মামলা হওয়ার পর তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুধবার (২০ নভেম্বর) ঢাকাটাইমসকে জানান, আগের সরকারের আমলে যারা মামলা দেখভাল করতেন তারা এখন ডিবিতে নেয়। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে নতুন একজন কর্মকর্তাকে নথিপত্র দেওয়া হয়েছে। তিনি চলতি সপ্তাহে কাগজপত্র বুঝে নিয়েছেন।
আনার নিখোঁজের আট দিন পর গণমাধ্যমে খবর আসে, তাকে হত্যা করে মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় ভারতে একজন, নেপালে একজন এবং বাংলাদেশে নারীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভারতীয় সিআইডি পুলিশ দেশটিতে এই ঘটনা মামলার তদন্ত করছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চলতি বছরের ১২ মে ভারতে যান আনোয়ারুল আজিম আনার। পরের দিন বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন তিনি। ২২ মে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। ওই দিন মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিবিকে। ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশীদ, উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আ. আহাদ ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) শাহিদুর রহমান মামলা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রচার আছে, সীমান্তে চোরাকারবার ও আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোলাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা আনার। চোরাচালনসংক্রান্ত দ্বন্দ্বে আনার নিখোঁজ বা তাকে হত্যা করা হয়- এমন খবর শোনা যায় ঘটনার প্রথম থেকেই। আনারের খোঁজে ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশীদ দলবল নিয়ে ভারতে যান রহস্য উদ্ঘাটনে। দেশে এসে আসামি ধরতে হেলিকপ্টারে পার্বত্য এলাকার ওপর চক্কড় দিয়ে বেড়ান। সে সময় এসব তৎপরতা নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলেছে। এরপর থেকে আনারকে নিয়ে আর কোনো তৎপরতা নেই।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক বুধবার দুপুরে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলা তদন্তের জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে লোকবল সংকট থাকায় তিনি কাজ শুরু করতে পারেননি। দ্রুতই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো যাবে।’
আনার নিখোঁজের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, আনারকে খুন করা হয়েছে। এই কিলিং মিশনের প্রধান তারই বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নেওয়া নয়জনের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার হওয়া ঝিনাইদহ পৌরসভার সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুসহ সাতজন কারাগারে আটক। অন্য পাঁচজন হলেন- শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর, সিলিস্তা রহমান, ফয়সাল ও মোস্তাফিজুর রহমান।
আনারের স্বজনরা যা বলছেন
আনার ইস্যুতে ডরিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ঢাকা টাইমস। তবে তিনি ফোনে বা খুদে বার্তায় সাড়া দেননি। সাবেক এই সংসদ সদস্যের একাধিক আত্মীয়র সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমসের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, আনারকে নিয়ে এখন আর তেমন আলোচনা নেই। আগস্টের পর আনারের পরিবারের কেউ কালীগঞ্জে নিজ গ্রামে যাননি। তাদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। আনারের বড় মেয়ে অরিন পরিবারসহ গাজীপুর থাকেন। আর ছোট মেয়ে ডরিন ও আনারের স্ত্রী ঢাকাতে থাকেন। ডরিনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে এই হত্যার রহস্য নিয়ে পারিবারিকভাবে বিতর্ক আছে বলে জানান তারা।
আনারের এক নিকটআত্মীয় ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ডরিন এখন আর ডিএনএ পরীক্ষা করতে ভারতে যেতে চাচ্ছেন না। মাকে নিয়ে ঢাকাতেই আছেন তিনি। এখনো আমরা নিশ্চত না আনার জীবিত, নাকি মৃত।’
গণমাধ্যমে আসা আনার হত্যাকাণ্ড
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্রে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর হয় ‘আনার হত্যাকাণ্ডে’র নৃশংসতার কথা। বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে একটি লাল গাড়িতে আনার কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিবা গার্ডেনে যান ফয়সালের সঙ্গে। এরপর সেখানে আনারকে অচেতন করতে ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয়। পরে তাকে একটি চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে গলাটিপে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে ওই ফ্ল্যাটের বাথরুমে নিয়ে চাপাতি দিয়ে টুকরা টুকরা করা হয় আনারের মরদেহ। এসব দেহাংশ ব্রিফকেসে ভরে ফেলে দেওয়া হয় কলকাতার বিভিন্ন ডোবায়। তারই কিছু মাংসখণ্ড উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশের দাবি।
আনার নিখোঁজের ঘটনায় তদন্ত করার সময় সঞ্জিবা গার্ডেনের সুয়ারেজ লাইন থেকে কিছু মাংসের টুকরা উদ্ধার করা হয়। এগুলো আনারের বলে ধারণা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, এই জনপ্রতিনিধির মরদেহ টুকরো-টুকরো করে ল্যাগেজে ভরে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে ফেলা হয়েছে বলে ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা স্বীকার করেছে। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আনার নিখোঁজের মীমাংসা টেনে যাচ্ছে না।
(ঢাকাটাইমস/২০নভেম্বর/এসএস/মোআ)
মন্তব্য করুন