বইঃ আমার কথা
‘সময়, শ্রম ও অধ্যবসায়’
সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘আমার কথা’। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকান্ড, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন। এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ‘ঢাকাটাইমস২৪ডটকম’ ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। বইটির আজকের পর্বে থাকছে- ‘সময়, শ্রম ও অধ্যবসায়’
সময়কে যেকোনো কাজে যথাযথভাবে ব্যবহার করাটা অতি জরুরি। একজন মানুষকে ঠিক করতে হবে কত কম সময়ে কত বেশি কাজ করা যায়। আর সেটা করার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে ও যথাসময়ের টাইম ফ্রেম ঠিক করতে হবে। কাজটা কেন করছেন এবং সেই কাজের লক্ষ্যটাও ঠিক করতে হবে। সব ঠিক করলে কম সময়ে অনেক বেশি কাজ করে সফল হওয়া যাবে। আমি কম সময়ে অনেক কাজ করতে পারি এবং করি। এটা কেমন করে সম্ভব অনেকে এটা আমার কাছে জানতে চান। তাঁদের আগ্রহ আমি অল্প সময়ে এত কাজ সম্পন্ন করতে কীভাবে সময়কে ব্যবহার করি। আমি বিষয়টি পরিষ্কার করছি। প্রথমত এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব হচ্ছে আমার সক্রিয় ও কঠোর পরিশ্রমী কর্মীবাহিনীর, যাঁরা আমাকে পেছনে থেকে সকল কাজ সম্পাদন করে দেন। তবে এ কর্মীবাহিনীকে যথাযথভাবে গড়ে তোলার পেছনে আমার সময়ানুবর্তিতার যে ভূমিকা রয়েছে- তা বিনয়ের সঙ্গে প্রকাশ করছি। মনে রাখবেন, আপনার কর্মীবাহিনী কেমন হবে তা বহুলাংশে নির্ভর করবে আপনার ওপর ।
সময় ও জীবনের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। পরিবারকে সময় দিতে হবে এবং কাজের জন্য, নিজের জন্য, শখের জন্য, আত্ম-উন্নয়নের জন্য, সর্বোপরি, সামনে এগিয়ে যাবার জন্য সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারের কৌশল জানতে হবে। না জানলে তা অনুশীলন, অধ্যবসায় কিংবা ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে আয়ত্তে আনতে হবে। সময় যতই সংক্ষিপ্ত বা দ্রুতগামী হোক না কেন, অধ্যবসায়ীর কাছে দৌড় প্রতিযোগিতায় সে পরাজিত হতে বাধ্য। কোনো অধ্যবসায়ীকে সময় হারাতে পারে না, সময়ই তার কাছে হেরে যায়।সময়ের বিষয়ে আমি বলতে চাই, একদিনে ২৪ ঘণ্টা সময় পাই; আমরা সময়কে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করি, প্রশ্ন সেটা নয়, বরং প্রশ্ন হচ্ছে- কীভাবে আমরা আমাদের সময় ব্যয় করি। কতকগুলো কাজ আছে, যেগুলো আমরা কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারি- এই যেমন, তিন ঘণ্টার সম্মেলনকে আধা ঘণ্টায় এবং এক মাসের কাজ এক সপ্তাহে সম্পন্ন করতে পারি। এরকম দক্ষতা অর্জন অবশ্যই সম্ভব এবং আমরা যদি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কাজ সম্পন্ন করা কোনো ব্যাপারই নয়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক কাজ সম্পন্ন করার জন্য আপনার যথেষ্ট সময় না-ও থাকতে পারে, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় যেন থাকে। এটি মনে রেখে কার্যবিভাজন ও কর্মসম্পাদন পরিক্রমা সজ্জিত করলে সময় দেখবেন অফুরন্ত হয়ে উঠেছে। আমি মূলত এভাবে আমার কর্মযজ্ঞকে বিভাজন করে থাকি।
অপরদিকে, সময়ের ব্যবহার অত্যন্ত সুচারু হওয়া উচিত। সময় ও জীবনের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। পরিবারকে সময় দিতে হবে এবং কাজের জন্য, নিজের জন্য, শখের জন্য, আত্ম-উন্নয়নের জন্য, সর্বোপরি, সামনে এগিয়ে যাবার জন্য সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারের কৌশল জানতে হবে। না জানলে তা অনুশীলন, অধ্যবসায় কিংবা ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে আয়ত্তে আনতে হবে। সময় যতই সংক্ষিপ্ত বা দ্রুতগামী হোক না কেন, অধ্যবসায়ীর কাছে দৌড় প্রতিযোগিতায় সে পরাজিত হতে বাধ্য। কোনো অধ্যবসায়ীকে সময় হারাতে পারে না, সময়ই তার কাছে হেরে যায়।
সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করুন, আপনার অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো জেনে নিন, জীবনকে উপভোগ করুন এবং এ পৃথিবীতে আপনার কাজের চিহ্ন রেখে যান। সময়ের সঠিক ব্যবহার না জানলে এর অপচয় হবে। সময়ের অপচয় করা মোটেই ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ্তালা একজন মানুষকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন কিছু অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে। সময়ের অপচয় হলে অনেক কাজ বাকি থেকে যাবে। অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করা যাবে না। তা করা না গেলে তিনিও অসন্তুষ্ট হবেন। তাঁর কাছে ফিরে যাওয়ার সময় এমনভাবেই যেতে হবে, তিনি যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন তা যেন সম্পন্ন করে ফিরে যাওয়া যায়। এই জন্যই কথায় আছে- সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। সময় সবার সব সময়ে অনুকূলেও থাকেনা। তাই সব কাজ ভেবেচিন্তে করতে হবে।
সময়ই হচ্ছে জীবন। একে জমিয়ে বা থামিয়ে রাখা যায় না। সময় চলমান নদীর মতো। পানির স্রোতকে থামিয়ে রাখা যায় না। আমার জীবনের মূলনীতি হচ্ছে, প্রতিটি মিনিটই আমার জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মূল্যবান, তাৎপর্যময়, আনন্দময় এবং ভালো কাজ সম্পাদনের মাধ্যম। যদি আপনি তা চান, তাহলে আপনাকে জীবনের প্রতিটি মিনিট কাজে লাগাতে হবে। কখনও কাজ ও চিন্তাকে থামিয়ে রাখবেন না। জীবনের প্রতিটি মিনিটকে আনন্দময় এবং উদ্ভাবনাময় করে তোলার চেষ্টা করুন এবং নিশ্চিত থাকুন এসব আপনার জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে।
আজ যাকে পাব কাল তাকে না-ও পেতে পারি। তাই আমার সঙ্গে যাঁরা আছেন, যাঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে- সবাইকে জীবনের অংশ মনে করে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করি।সময় নদীর স্রোতের মতো, আপনি এই স্রোতকে একস্থানে দুই বার আটকে রাখতে পারবেন না। জীবনের সময় ক্রমশ কমতে থাকে। মানুষ বয়স গণনা করে বলে, বয়স কত হলো, মানে কত বাড়ল। আসলে তো তার বয়সটা বাড়ছে মনে হলেও পৃথিবীতে তার সময়টা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এই কারণে সময়কে গুনতে হবে উল্টো করে। ভাবতে হবে জীবনের সময় থেকে এক একটি করে দিন কমে যাচ্ছে। হাতে বেশি সময় নেই- সেটাও মনে রাখতে হবে। আর কাজ করতে হবে বেশি। এখনকার কাজ পরবর্তী সময়ের জন্য, আজকের কাজ কখনও আগামীকালের জন্য ফেলে রাখা যাবে না। তা করলেই হিসাব মিলবে না। অলসতা পরিহার করা জরুরি।
প্রতি সেকেন্ড আমার কাছে নতুন, প্রতিটি নতুন সূর্য আমাকে একটি নতুন জীবন উপহার দেয়। তাই আমি বর্তমানকে গুরুত্বের সঙ্গে বরণ করি, ব্যবহার করি, আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করি। প্রতিটি মুহূর্তকে অবস্থা বিবেচনায় অভিযোজনীয় কৌশলে নান্দনিক করে তুলি। শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্য- প্রতিটির আনন্দ আছে, সার্থকতা আছে। আমার উপলব্ধিই আমার উপভোগ। মানুষ এককভাবে বাস করতে পারে না। প্রত্যেককে নিয়ে আমি, আমাদের নিয়ে সমাজ, দেশ ও জাতি। আজ যাকে পাব কাল তাকে না-ও পেতে পারি। তাই আমার সঙ্গে যাঁরা আছেন, যাঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে- সবাইকে জীবনের অংশ মনে করে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করি।
প্রতিটি নতুন দিন নিয়ে আসে নতুন সুযোগ। যাঁরা মিনিটের পর মিনিট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এবং দিনের পর দিন অযথা ব্যয় করেন, কোনো মূল্যায়নই করেন না, তাঁরা জীবনকেই মূল্যায়ন করেননি। আমার খুব দুঃখ হয়, যখন দেখি তরুণরা বহু সময় সিনেমা দেখার পেছনে, কফি হাউজে, টিভি এবং ভিডিও গেম্স্ খেলে অযথা সময় নষ্ট করে। তাদের এই সময়গুলো ছিল দেশের, সমাজের, পরিবারের এবং প্রজন্মের উন্নতির ও সমৃদ্ধির জন্য খুবই মূল্যবান সম্পদ। অনেকে আমার কর্মকে কষ্ট মনে করে বিশ্রামের আশ্রয় নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। প্রকৃতপক্ষে কাজের চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। Work is man's most natural form of relaxation.54 Work is not punishment. It is reward, strength, pleasure.
সময়কে যথাযথ ব্যবহারের আর একটি কৌশল হচ্ছে কর্মবিভাজন। আমি তা-ই করি, যা করতে পারি, তা-ই চাই যা আমার আছে; আমি তা হতে চাই যা আমি ইতোমধ্যে হয়ে আছি। এর বেশি কিছু চেয়ে হতাশ হতে চাই না। হতাশা মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব নষ্ট করে দেয়। আমি হতাশ হই না, কারণ হতাশ করার মতো কোনো উচ্চাকাক্সক্ষায় আমি নিজেকে জড়াই না, আমার আকাক্সক্ষা অন্যের কাছে উঁচু হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তা আমার আয়ত্তের জিনিস। তাই আমি সবসময় প্রফুল্ল থাকি। আমার হাসি আমার প্রফুল্লতার প্রকাশ। আমাকে আমার কর্ম দ্বারা বড় হতে হবে। আপনাকে কেউ বড় হবার জন্য অনুগ্রহ করবে না। আপনার দক্ষতাই আপনাকে সহায়তা দেবে। আপনার বোঝা আপনাকেই বহন করতে হবে। আপনার শরীরের কষ্ট আপনার নিজের। কেউ এর ভাগ কখনও নেয়নি, নেবেও না এবং নিতে পারে না। মনে রাখবেন, যেখানে পরিশ্রম নেই, সেখানে কোন সাফল্য নেই। চেষ্টা ও কর্মের উপরে মানুষের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠে। জীবনে সুখী হতে হলে- সহিষ্ণুতা, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস চাই এবং পরিশ্রম চাই। তাহলে সব দুঃখের কালো ছায়া মাথার উপর থেকে সরে যাবে- জীবন নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হবে।
সময়কে ব্যবহার করতে হবে সময়ের মতো নিষ্ঠায়। আর তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে স্বপ্ন, জ্ঞান-অনে¦ষণ আর অধ্যবসায়ী শ্রমে- Dream, Discover and Do। স্বপ্ন দেখতে হবে সৃজনশীলতার। তবে শুধু নিজের কল্যাণের জন্য স্বপ্ন দেখলে হবে না। সবার জন্য স্বপ্ন দেখতে হবে। জানতে হবে এবং জানার কোনো বিকল্প নেই। নিজে কাজ না করে অন্যের কাছ থেকে পাওয়ার প্রত্যাশা ভিক্ষাবৃত্তির নামান্তর; এমন আচরণ ব্যক্তিকে পরমুখাপেক্ষী করে রাখে। নিজের স্বপ্ন নিজে বাস্তবায়ন করতে পারার মতো আনন্দ আর কিছু হতে পারে না। মনে রাখবেন, সময়ের সদ্ব্যবহার হলো সবচেয়ে বড় সম্পদ। অর্থ সম্পদ হারালে তা ব্যবসা-বানিজ্যের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। জ্ঞানের অভাব হলে তা অধ্যয়নের মাধ্যমে পূরণ করা যায়। স্বাস্থ্য নষ্ট হলে সংযম দ্বারা, চিকিৎসা দ্বারা পুনরুদ্ধার করা যায়। কিন্তু সময়ের সদ্ব্যবহার করা না গেলে তা চিরদিনের জন্য চলে যায়।
একটি বছর ৩৬৫ দিনের সমষ্টি। ভালো কথা, তবে আমি বলি : বছর হচ্ছে কতগুলো দিনের সমষ্টি, যা আপনি ব্যয় করছেন পরিবারের, সমাজের এবং আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য। কেননা এই দিনগুলোই একমাত্র গণ্য হবে, যখন আপনি জীবনী লিখবেন। সুতরাং প্রতিটি মিনিট, ঘণ্টা এবং দিনকে কাজে লাগান। সময়কে ভালো কাজে ব্যয় করুন। আপনার অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো জানুন, জীবনকে উপভোগ করুন এবং এই পৃথিবীর বুকে পদচিহ্ন রেখে যান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- কোনো সময়ই এমন কাউকে আপনার জীবনের সঙ্গে জড়াবেন না, যা আপনার সময়কে চুরি করে নিয়ে যাবে। এরকম যদি কেউ আপনাকে পেয়ে বসে, তবে তারা আপনার জীবনকেই চুরি করে নিয়ে যাবে। তাই সাবধান।
আগামীকাল কাল থাকছে - “বাংলার বসন্ত” আরও পড়ুন - ‘আমার আদর্শ আমার নায়ক’ , ‘ধৈর্য পরীক্ষা’, ‘খেলাধুলা ও বাংলাদেশ’ ‘অধ্যয়ন, লেখালেখি ও নেতৃত্ব’ ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ’, ‘সাফল্যের স্বর্ণদ্বার’ , ‘ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাফল্যের মেরুদণ্ড’ ‘পদ্মা সেতু’, `বিজয়চিহ্ন 'V' প্রকাশে ভিন্নতা', ‘উন্নয়ন ও অগ্রাধিকার’ , ‘ইতিবাচক ভাবনা সাফল্যের চাবিকাঠি’ , ‘ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে’ ‘মাতৃভাষার প্রতি মমতা’, ‘সুখ ও শান্তি : আমাদের করণীয়’ , ‘নেতৃত্বের শক্তি’, ‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’, ‘আমার প্রাত্যহিক জীবন’, 'আমার অনুভব'।
মন্তব্য করুন