‘পদ্মা সেতু বিলম্বের দায় কে নেবে?’

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৩:৫৯ | প্রকাশিত : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:১৫

পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এখন পর্যন্ত টাকার অংকে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটিকে পিছিয়ে দিল পাঁচ বছর। আরো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে সেতুটি চালুর জন্য। ২০১৮ সালের শেষ দিকে সেতুটি চালুর কথা জানাচ্ছে সরকার।

আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটির এই অভিযোগের প্রমাণ পায়নি বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু তারপরও দমেনি বিশ্বব্যাংক। মামলা হয় কানাডার আদালতেও। সেই আদালত জানিয়ে গিয়েছে, এই প্রকল্পে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ তারা পায়নি। বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ এনেছে তাকে ‘অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজবের বেশি কিছু নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন বিচারক।

তবে বিশ্বব্যাংক অধ্যায় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ দমে যায়নি। নিজ অর্থায়নে সেতুর কাজ শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, বাংলাদেশ সেতু করছে ঠিক আছে, কিন্তু বায়বীয় অভিযোগ তুলে পাঁচ বছরে যে ক্ষতি হয়েছে সেটা কে দেবে?

অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন, দেশের বৃহত্তম এই সেতু হলে প্রতি বছর জিডিপিতে যোগ হবে ১.২ শতাংশ। টাকার অংকে এটা ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ টাকার অংকে এই সেতু পাঁচ বছর আটকে যাওয়ায় ডিজিপিতে এক লাখ কোটি টাকা যোগ হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশ।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংক টালবাহানা শুরুর পরই বাংলাদেশ ব্যাংকের সে সময়ের গভর্নর আতিউর রহমান নিজ অর্থায়নে সেতুর কাজ শুরু করতে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে সে সিদ্ধান্ত নিতে নিতেও বছর দেড়েক সময় চলে যায়।

জানতে চাইলে আতিউর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্র নিয়ে কানাডার আদালত যা বলেছে, সেটি তো আমার কাছে শুরু থেকেই এমন মনে হয়েছে। ওই সময় যদি তাৎক্ষণিকভাবে আমরা ওখান থেকে সরে এসে কাজ শুরু করতাম তাহলে কিন্তু আমরা পিছিয়ে যেতাম না। এতদিনে সেতুর কাজ শেষ হয়ে যেত।’

বিশ্বব্যাংক যা বলেছিল আর কানাডার আদালত যা বলেছে

পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করে গণমাধ্যমে দেয়া বিবৃতিতে ২০১২ সালের ৩০ জুন বিশ্বব্যাংক বলে, ‘২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে দুটি তদন্তের তথ্য প্রমাণ প্রদান করেছে। আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টির পূর্ণ তদন্ত করতে এবং যথাযথ বিবেচিত হলে দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম। আমরা এ পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, কারণ আমরা আশা করেছিলাম যে সরকার বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্বআরোপ করবে।’

ওই বিবৃতিতে এমনও বলা হয়, `বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ঘটনায় চোখ বুজে থাকতে পারে না, তা উচিত নয় এবং থাকবেও না। আমাদের শেয়ারহোল্ডার ও আইডিএ দাতাদেশগুলোর প্রতি আমাদের সুষ্ঠু আর্থিক দায়বদ্ধতা এবং সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্ব রয়েছে। এটি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব যে আইডিএ সম্পদ কাঙ্খিত লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কেবল তখনই একটি প্রকল্পে আমরা অর্থায়ন করবো যখন আমরা যথেষ্ঠ নিশ্চয়তা পাবো যে প্রকল্পটি পরিস্কার ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হবে।'

বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ তুলে দুর্নীতির ঘটনায় চোখ বুঁজে থাকতে পারে না বলেছে, তাকেই কানাডার আদালত ছুড়ে ফেলেছে।

অন্টারিও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ইয়ান নরডেইমার আদেশে বলেন, ওই তিন আবেদনের বিষয়ে তার ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। এগুলোতে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলো ‘অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজবের বেশি কিছু নয়।’ তিনি এও বলেন, ‘ওই গুজব বা অনুমানকে সমর্থন করে এমন ঘটনা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ হাজির করা হয়নি বা তার তদন্ত হয়নি। যে তথ্য‌ সরবরাহ করা হয়েছে তা শোনা কথা’।

‘বিশ্বব্যাংককেই জিজ্ঞেস করুন’

বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলার সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন গোলাম রহমান। সে সময় সংস্থাটি এই অভিযোগের তদন্ত করে বলার মতো কিছুই পায়নি। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সময় বৈঠকও করে দুদক। এসব বৈঠক শেষে গোলাম রহমান বলেছিলেন, তারা এই তদন্তে তেমন কিছু পাননি। আর বিশ্বব্যাংকও তাদের কিছু সরবরাহ করেনি।

যোগাযোগ করা হলে গোলাম রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যে অভিযোগে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের চুক্তি বাতিল করল তা যে ষড়যন্ত্র ছিল সেটি আমরাও বলেছিলাম। কিন্তু বিশ্বব্যাংক সেই সময়ে তাদের অভিযোগের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়। এটা প্রমাণ করার জন্য তারা সবকিছুই করেছে।’

গোলাম রহমান বলেন, ‘এখন বিশ্বব্যাংককে ধরা উচিত। তারা কেন এ রকম একটি ভুয়া অভিযোগ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আনল। তাদের কাছে জিজ্ঞাস করা উচিত কেন তারা এমনটা করল।’

দুদকের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের ওই বৈঠকে কী কথা হয়েছিল, জানতে চাইলে গোলাম রহমান বলেন, ‘তখন তাদের সঙ্গে আমার অনেক কথাই হয়েছে। কিন্তু দায়িত্বশীল ও নৈতিক অবস্থান থেকে সেগুলো এখন বলা যায় না। কিন্তু গণমাধ্যমের উচিত বিশ্বব্যাংককে ধরা। তাদের প্রশ্ন করা। কেন তারা এমনটা করল।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকে আমাদের যে নির্বাহী পরিচালক আছেন তার বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে তোলা উচিত। সেখানে এমন সিদ্ধান্ত পাস করা উচিত যেন ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা যেন না ঘটে। এরফলে বিশ্বব্যাংক বুঝবে যে যেনতেন বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাতিল করা যায় না।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে আতিউর রহমান বলেন, ‘যেসব মানুষের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় কি না সে বিষয়ে আইনজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। তবে অপরাধীর শাস্তি পাওয়া উচিত।’

আওয়ামী লীগ নেতারা যা বলছেন

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর ক্ষমতাসীন দল হিসেবে ব্যাপক চাপে পড়ে আওয়ামী লীগ। এই অভিযোগকে বারবার মিথ্যা বললেও দেশবাসীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল স্পষ্ট।

কানাডার আদালতের রায়ের পর এখন স্বস্তিতে আওয়ামী লীগ্। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘কানাডার আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই এটা বলে আসছে। সেটা আজ আদালতে প্রমাণিত হল।

এক প্রশ্নের জবাবে রাজ্জাক বলেন, ‘একজন ব্যক্তির কারণে ওই সময়ে পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক। কানাডার রায়ে সেই ব্যক্তির মুখোশ বিশ্ব বিবেকের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। যারা ওই সময়ে ষড়যন্ত্র করেছে তাদের সবার মুখোশ আজ উন্মোচিত হয়েছে।’

যাদের কারণে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বাতিল করল বিশ্বব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে এখানে ব্যবস্থা নেয়ার তো কিছু নেই। তবে মানুষের কাছে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে। এবং তারাও তাদের বিবেকের কাছে দংশের শিকার হচ্ছে বলে আমার কাছে মনে হয়।’

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখে রা নেই

কানাডার আদালতের রায়ের পর বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেইনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকাটাইমস। তবে তিনি কিছুই বলতে রাজি জননি। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি মেহেরুন এ মাহবুবের (জনসংযোগ কর্মকর্তা) সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’

মেহেরিন এ মাহবুবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা মাত্রই অবগত হলাম। আমাদের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিক্রিয়া দিতে হবে। তিনি এই মুহূর্তে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ হচ্ছে। কোনো আপডেট থাকলে আপনাকে জানাব।’

কী ঘটেছিল তখন

দুর্নীতির এই অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল হয়ে যায়। পরে নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দেয় বাংলাদেশ সরকার।

দুর্নীতির ওই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য হন সেই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন। অভিযোগ ছিল সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও। তবে তাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে দুদকের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১০ সালে নিজেরা তদন্ত শুরু করে। অভিযোগ সম্পর্কে নিজেদের তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে (আরসিএমপি) অনুরোধ জানায়।

ওই অনুরোধে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডায় এসএনসি-লাভালিনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২০১২ সালে টরোন্টোর আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে এসএনসি-লাভালিনে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস ও ব্যবসায়ী জুলফিকার ভূইয়াকেও এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়।

সে সময় রমেশ শাহের কাছ থেকে কানাডীয় পুলিশের জব্দ করা একটি ডায়েরি নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়, যাতে ‘বাংলাদেশের কাকে কত শতাংশ ঘুষ দেয়া হবে’ তার সাংকেতিক বিবরণ ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়। এদিকে বিশ্বব্যাংকের চাপে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদক ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা করে। ২২ মাস তদন্ত করে তদন্তকারীরা বলেন, অভিযোগের কোনো প্রমাণ তারা পাননি।

দুদক চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ায় ২০১৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে পদ্মা দুর্নীতি মামলার অবসান ঘটে, তখনকার সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দেয় আদালত।

(ঢাকাটাইমস/১১ফেব্রুয়ারি/এমএম/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :