আটটার ডাক্তার কয়টায় আসে?

সৈয়দ অদিত, শোভন চৌধুরী ও আউয়াল খাঁন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১২:৪৮ | প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:৩৮

হাসপাতাল খোলার কথা সকাল আটটায়। কিন্তু রাজধানীর মুগদায় অবস্থিত মুগদা জেনারেল হাসপাতালে গেলে আপনাকে বসে থাকতে হবে দীর্ঘ সময়। এখানে রোগী দেখা শুরু হয় আরও পরে। কখনো নয়টা, কখনো সাড়ে নয়টা বেজে যাবে। এরপর ডাক আসবে অথবা আসবে না। তবে দেরি করে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হলেও ছুটির সময় কাটায় কাটায় দুইটা।

বেশ কজন রোগীর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর গত শনিবার হাসপাতালে গিয়ে এই অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেল সেখানে। সকাল সাড়ে নয়টার সময়ও সেদিন সেখানে চিকিৎসকরা রোগী দেখা শুরু করেননি। কেন এমনটি হচ্ছে- সে নিয়ে হাসপাতালের কর্মীদের কাছে কোনো জবাব পাওয়া গেল না। বেশ কয়েকজনের কাছে প্রশ্ন করলে কেউই জবাব দেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি।

একই দিন রাজধানীর প্রধান দুটি সরকার হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে গিয়েও পর্যবেক্ষণ করে যথাসময়ে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হতে দেখা যায়নি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হতে হতে সকাল নয়টা বেজে যেতে দেখা গেছে। সে তুলনায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে তুলনামূলক কম বিলম্ব হয়।

হাসপাতালে নানা বিশৃঙ্খলা আর অনিয়মের মধ্যে সঠিক সময়ে রোগী দেখা শুরু না করাও এক সাধারণ অভিযোগের নাম। এ নিয়ে রোগীরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের করণীয় কিছু থাকে না।

মুগদা হাসপাতালে এক দিনের চিত্র

কমলাপুর রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে বিশাল আবাসিক এলাকায় সরকারি চিকিৎসা সেবার প্রধান ভরসা হতে পারত হাসপাতালটি। ২০১৩ সালে প্রায় ১০ একর জমিতে ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় ৫০০ শয্যার এই হাসপাতাল। উদ্বোধনের সময় বলা হয়েছিল, ওই এলাকার মানুষের চিকিৎসা সেবায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে এটি। কিন্তু গত প্রায় চার বছরে সে আশার কতটা পূরণ হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

শনিবার হাসপাতালটিতে সকাল নয়টা তিন মিনিটে গিয়ে শিশু বিভাগে দুজন চিকিৎসককে টিকা দিতে দেখা গেছে। মেডিসিন, গাইনিসহ অন্যান্য বিভাগে চিকিৎসকরা তখনো আসেননি। মেডিসিন বিভাগের প্রধানের কক্ষে তার চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছিলেন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মী।

হাসপাতালের রোগ পরীক্ষা কেন্দ্রের তালাও তখনো খোলেনি। গাইনি বিভাগের একটি কক্ষের সামনে তখন বসে ছিলেন বেশ কয়েকজন রোগী। কিন্তু দরজায় তালা। চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক মমতাজ হোসেন আসবেন কি না, সেটা বলতে পারছিলেন কেউ। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ ছিল।

পাশেই নিউরোলজি বিভাগেও ছিলেন না কোনো চিকিৎসক। মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ইউসুফুর রহমানকেও তার কক্ষে পাওয়া যায়নি। তিনি কেন আসেননি জানতে চাইলে হাসপাতালের কর্মীরা কোনো জবাব দেননি।

পাশেই সেবিকাদের কক্ষে কয়েকজনকে পাওয়া গেল। তারা রোগীর ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে মোবাইল ফোন আর আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নুরুল আমিনকেও তার কক্ষে গিয়ে পাওয়া গেল না।

জরুরি বিভাগে ঢুকতে চাইলে বাধা দিলেন ওয়ার্ডবয় এবং একজন নার্স। কাকে চাই? প্রশ্ন করেন একজন।

ডাক্তার কারা আছেন- জানাতে চাইলে ওয়ার্ড বয় বলেন, রোগী নিয়ে আসেন, এরপর আমরা দেখছি।

কখন ডাক্তারকে পাওয়া যাবে খোঁজ নিতে অভ্যর্থনায় (রিসিপশন) গিয়েও ব্যর্থ হতে হলো। সেখানেও কেউ নেই।

সার্জারি বিভাগে গিয়ে কথা হলো এক রোগী সুবর্ণা জাহানের সঙ্গে। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ফোন দিয়ে আমি আমার সিরিয়াল কেটে রেখেছিলাম। সেখানে আমায় সময় দেয়া হয়েছিল সকাল নয়টায়। কিন্তু এখন ১০টার উপরে বাজে তাও ডাক্তারের খবর নেই।’ তাহলে কী করবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কী আর করব বলেন? আমরা এখানে অসহায়। আর ডাক্তাররা আমাদের অসহায়ত্বকে কাজে লাগাচ্ছে।’

শিশু বিভাগে পারভীন আক্তার নিয়ে এসেছেন তার চার বছর বয়সী নাসরীন আক্তারকে নিয়ে। তার মেয়ে প্রায় ২০ দিন ধরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। পারভীনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন ঘড়ির কাঁটা আরও এগিয়েছে। তিনি বলেন, ‘বলল আজ (রবিবার) সকাল দশটায় আসতে। এগারোটা বাজতে চলল তবুও ডাক্তারের খবর নেই।’

হাসপাতালের এই চিত্র কেন- জানতে পরিচালক আজিজুন নাহারের কক্ষে গিয়ে তাকেও পাওয়া যায়নি। পরিচালক কোথায়-সে প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যায়নি।

পরে হাসপাতাল থেকে ফিরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। একজন ফোন ধরে নিজেকে পরিচালকের পিএস বলে পরিচয় দেন। তাকে পুরো ঘটনা জানিয়ে পরিচালকের বক্তব্য নেয়ার কথা বলা হয়।

তখন পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়দানকারী ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আপনি নিউজ করলে পরিচালকের নাম বাদ দিয়ে করবেন।’ কেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার নাম দেয়ার কোন যৌক্তিক কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। আপনি যত যাই বলেন নাম দেয়া যাবে না’।

নিজের নামটিও বলতে রাজি হননি ওই ব্যক্তি। আর এক পর্যায়ে তিনি ফোন কেটে দেন।

ঢাকা মেডিকেলে যা দেখা গেল

সকাল আটটার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা গেলো শামসুল মিয়া নামে এক রোগীকে। তিনি বলেন, ‘ভোরে টেরাকেরতে নামনের সুম হাত কাইট্টা গেসিল। অহনকা আইয়া দেহি ডাক্তর নাইক্কা। হেগোরে ধইরা বাঁশ দিবার মন চায়’।

আটটার সময় চিকিৎসা শুরু হওয়া দূরের কথা, সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও শিশু, সার্জারি ও নিওরোলজি বিভাগে চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া গেলো না। তবে তাদের কক্ষগুলো খোলা হয় সকাল আটটার আগেই।

শিশু বিভাগে গিয়ে একজন আয়াকে চিকিৎসকের কক্ষের বাইওে চেয়ারে বসে ঘুমাতে দেখা গেলো। তাকে ডেকে তুলে ডাক্তার কখন আসবে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সুমাইয়া আপার (শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক) আসার কথা সকাল আটটায়। উনি সাধারণত সকাল দশটা-সাড়ে দশটায় আসেন। এই বলে তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়েন।’

বর্হিবিভাগে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। সেখানেও জানা গেলো, ডাক্তাররা আসেন নয়টার পর। সকাল সোয়া নয়টার পর থেকে হাসপাতাতলের বর্হিবিভাগে ডাক্তারদের ধীরে ধীরে আসতে দেখা যায়।

তখন জড়ো হওয়া রোগীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় হাসপাতালের তীব্র সমালোচনা করছিলেন। সাভার থেকে আসা নাসরীন বেগম ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘এত দূরেরতে আইছি ভালো সেবা পামু বইল্লা, আর অহন দেখি ডাক্তারই আহে না ঠিক মতন।’

তাহমিনা আক্তার নামে আরেক রোগী বলেন, ‘ডাক্তর গো লগে কথা কইয়া শান্তি পাওন যায় না। একটা প্রশ্ন না বুঝলে আরেকবার জিগাইলে ক্ষেইপা উডে।’

হাসপাতালের পরিচালক মিজানুর রহমানের কক্ষে গিয়ে সকাল সোয়া নয়টার সময় পাওয়া গেলো না তাকেও। ফলে হাসপাতালের এই দশা নিয়ে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছাড়াই ফিরতে হলো।

বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো

দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালটিতেও নির্ধারিত সময়ে রোগী দেখা শুরু হতে দেখা গেলো না। তবে অন্য দুটি হাসপাতালের তুলনায় এখানকার সময়ানুবর্তিতা ভালো। এখানে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই রোগীদের চিকিৎসকের কক্ষে ঢুকতে দেখা গেলো।

স্বভাবতই সময়ানুবর্তিতা নিয়ে এই হাসপাতালে রোগীদের মধ্যে তেমন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে তারা টিকিট টাকতে গিয়ে ভোগান্তির কথা জানান।

একজন রোগী বলেন, কাউন্টারে লম্বা লাইন হওয়ার কারণ সেখানে চারজন মাত্র টিকিট কাটেন। কিন্তু রোগী থাকে অনেক।

আরেক রোগী বলেন, এক জায়গায় টিকিট কাটার ব্যবস্থা না করে বিভাগের সামনে কাউন্টার বসালে ভোগান্তি কম হতো।

(ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি/এসও/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :