রাজ্জাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি

রুহেল বিন ছায়েদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৪৬ | প্রকাশিত : ২২ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৩৭

আমি যখন লিখছি তখন প্রকৃতি অঝোরে কাঁদছে। সোজা বাংলায় আপনি আমি এটাকে ‘বৃষ্টি’ বলে চালিয়ে দিতে পারলেও আজকের রজনীতে এই ‘বৃষ্টি’ নেহাত ‘বৃষ্টি’ হয়ে যে আসেনি তা আমি বুকে হাত দিয়ে বলছি। অঝোর বৃষ্টি, সঙ্গে সর্বোচ্চ শব্দে বাজছে আমার হাঁপিয়ে ওঠা সাউন্ড বক্স। টিনের চালের বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে ঠিকই প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে সাউন্ড বক্স... উঁহু! গানের কলি শুনুন-

‘আমার মত এত সুখী

নয় তো কারো জীবন

কি আদর স্নেহ ভালবাসা

জড়ানো মায়ার বাঁধন

জানি এ বাঁধন ছিঁড়ে গেলে কভু

আসবে আমার মরণ...'।

বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। বিশ্বাস করুন মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে গেছে... আমি নিজেকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য হচ্ছি যে আমার আব্বুর, আমার আম্মুর সময়ের স্বপ্নপুরুষ আর আমার সময়ের সবচেয়ে উপেক্ষিত এক এবং একমাত্র ‘মহানায়ক’ মায়ার সকল বাঁধন ছিঁড়ে মরণকে বরণ করেছেন। ‘নায়ক রাজ রাজ্জাক নেই’-এই বাক্যটি আমার সকল বিশ্বাসকে অবিশ্বাস করে বিশ্বাস করে নিতে হচ্ছে।

৭৫ বছর বয়সে পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চকে বিদায় বললেন বাংলাদেশের ‘মহানায়ক’। কতশত মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহ-মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে একটি সুখী জীবনকে বিদায় বললেন কিংবদন্তি রাজ্জাক।

একজন দীলিপ কুমার আমি দেখিনি; আমি দেখিনি বাঙ্গালি সিনেমার ‘মহানায়ক' উত্তম কুমারকেও। অমিতাভ বচ্চনের মতো প্রভাবশালী অভিনেতা আমি দেখে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গের শক্তিমান মিঠুন চক্রবর্তী তো এখনও বক্স আফিস কাঁপাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন; আমি একজন ‘নায়করাজ' রাজ্জাকে বুঁদ ছিলাম, আছি এখনও। ‘শিল্পী’ শব্দটির সংজ্ঞা আমি জানিনা। তবে কেনজানি সাদাকালো যুগের রাজ্জাককে স্ক্রিনে দেখলে মনে হতো একজন শিল্পীর শিল্পের বিকাশ দেখছি। মনে হতো অভিনয় ছাপিয়ে তিনি শিল্পের বিকাশ ঘটাচ্ছেন তার চোখ-মুখ আর বাঁচনভঙ্গিতে।

আমি এ যুগেরই এক তরুণ। নায়ক রাজরাজ্জাকের ছবি বড় স্ক্রিনে দেখার সৌভাগ্য স্বাভাবিকভাবেই আমার হয়ে ওঠেনি। ছেলেবেলা থেকে বিটিভির পর্দায় দেখে এসেছি তাকে। মনে পড়ে ওই দিনগুলোর কথা যখন বিটিভিতে সপ্তাহান্তে দুই কিংবা তিনটি সিনেমা দেখানো হতো। এলাকায় টেলিভিশন সেট ছিলো খুবই কম। ওই দিনগুলোতে বাংলা সিনেমা দেখার জন্য সবাই জমায়েত হয়ে যেতো আমাদের আঙ্গিনায়। সাদাকালো স্ক্রিন তার উপর ঝিরঝির অবস্থা। সবার অপেক্ষা রঙ্গিন যুগের ভালো একটি সিনেমার। শ্রেষ্ঠাংশে যখনই উপস্থাপিকা বলে ওঠতেন নায়ক রাজ্জাকের নাম তখন সবার মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারও মন্তব্য ‘আর কত রাজ্জাকের ছবি দেখতাম।’ এই বলে বিটিভিকে ভর্ৎসনা দিয়ে প্রস্থান অনেকের। বিশ্বাস করুন এই সুযোগেই আমি রাজ্জাকে বুঁদ হয়ে যেতাম। সে কি অভিনয়। আহা!

আমি এদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি রাজ্জাকে, আমি ভাষা আন্দোলন কি তা শিখেছি রাজ্জাকে, আমি বাংলার ইতিহাসের ভিজুলাইজেশন দেখেছি রাজ্জাকে। আমি বাঙালি হতে শিখেছি রাজ্জাকের বাঙালিয়ানা দেখে। একজন যোদ্ধা, মধ্যবিত্ত ঘরের ছোট ছেলে, বেকার প্রেমিক, একজন সবজান্তা হিরো, একজন মেঝো মামা, একজন আত্মত্যাগী বড় ভাই, একজন রংবাজ, একজন অবহেলিত বাবা এবং একজন দাদা- কি ছিলেন না রাজ্জাক?

‘বেহুলা’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমায় ১৯৬৬ সালে নাম লেখান আব্দুর রাজ্জাক। ৮ বছরেই শত ছবির মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালে ‘প্রতিনিধি’ নামে একটি ছবি মুক্তি পায়। ছবিটি মুক্তির পাওয়ার পরই পান 'নায়করাজ' উপাধি। উপাধি দেন তারই সহকর্মী অভিনেতারাই। ১০০তম ছবি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আলোকচিত্রসহ ফ্রেমবন্দি একটি লেখা উপহার দেন সোহেল রানা, আলমগীর, ফারুক, উজ্জ্বল, বুলবুল আহমেদ, ওয়াসিম, জাবেদ, খসরু, প্রবীর মিত্র, ফরহাদ, মেহফুজ ও কাসেম। লেখাটি ছিলো এরকম- ‘হে নায়করাজ, শতচিত্রের নাও আমাদের অভিনন্দন। শতাধিক হোক তোমার আয়ুর সুরভিত চন্দন, সাধনা তোমার নন্দিত আজ আনন্দ সন্ধানে। শিল্পীর সেরা আসনে বসেছ শিল্পরসিক সৃজনের প্রিয় প্রাণে, ওই দুর্লভ সম্মান চিরঅম্লান বন্ধন। তুমি আমাদের গর্ব এবং প্রেরণার প্রিয় উৎস, তোমার স্বপ্ন অঞ্জন চোখে খুঁজি নব উৎসর্গ, অগ্রজ নাও অনুজের ধ্যানে পুষ্পিত স্পন্দন।' তখন থেকেই আব্দুর রাজ্জাক হয়ে ওঠেছিলেন নায়ক ‘রাজরাজ্জাক’। বাংলা চলচ্চিত্র অঙ্গনে নিজ গুণে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে। আজ সেই নায়করাজ প্রস্থান করলেন আমাদের সকল মায়ার শক্ত বাঁধন ছিঁড়ে।

রাজ্জাক আমাদের দিয়েছিলেন আগুন নিয়ে খেলা,বেহুলা, অন্ধ বিশ্বাস, মাটির ঘর, বেঈমান, অশিক্ষিত, বদনাম ,রংবাজ, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নিচে, নাচের পুতুল, পিচঢালা পথ, আবির্ভাব, দ্বীপ নেভে নাই, টাকা আনা পাই, আলোর মিছিল, ছুটির ঘণ্টা, চন্দ্রনাথ, শুভদা, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, বাবা কেনো চাকর ছাড়াও অসংখ্য অগণিত চলচ্চিত্র। আমরা কি বিনিময়ে আদৌ তাকে সম্মানটুকু দিয়েছি?

আমাদের 'মহানায়ক' আজ নেই, আমাদের ‘নায়ক রাজরাজ্জাক' আজ নেই। বিশ্বাস করুন পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চ থেকে কতশত অভিমান আর চাপা কষ্ট জমিয়ে আজ তিনি প্রস্থান করেছেন। রাজ্জাক বাংলাদেশের না হয়ে যদি অন্য যেকোনো দেশের হতেন তবে নিশ্চিত আরও যোজনযোজন প্রতিপত্তি আর সম্মান নিয়ে প্রস্থান করতে পারতেন। রাজ্জাকের সে সুযোগ ছিলো না বললেও ভুল হবে। ভারতে তার চাহিদার কথা আমি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তবু বাংলাদেশ ছাড়েননি রাজ্জাক।

নায়করাজ বিদায় নিলেন। একজন বীরের জীবনের পরাজয় ঘটলো। আয়নাতে আর ওই মুখ দেখা হবে না। গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে বলো আর কি হবে? অশ্রু দিয়ে লেখা এ নাম তবু ভুলে যাবো না। তুমি যে আমার কবিতা, আমারও বাঁশির রাগিনী। একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে, ওগো বন্ধু কাছে থেকো কাছে থেকো।

রুহেল বিন ছায়েদ, শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, এমসি কলেজ, সিলেট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :