নতুন ঠিকানায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, উদ্বোধন রবিবার

অবশেষে কাঙ্ক্ষিত স্থায়ী অবকাঠামো পেতে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আগামীকাল (রবিবার) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থায়ী ভবনের উদ্বোধন করবেন। পরদিন সোমবার থেকে জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হবে নতুন ঠিকানার এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ রাজধানীর সেগুন বাগিচায় একটি ভাড়া করা দ্বিতল ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবিকৃত রাখার উদ্দেশ্যে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আর নতুন ঠিকানায় এই জাদুঘর পেতে যাচ্ছে একটি নয়তলা ভবন।
নতুন ভবনে স্থানান্তর উপলক্ষ্যে শনিবার সকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী মশাল নিয়ে একটি শোভাযাত্রা নিয়ে যাওয়া হয় আগারগাঁও ভবনে। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, নাতি-নাতনি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে এমন নতুন প্রজন্মের শত শত ছেলে-মেয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। শোভাযাত্রায় মশাল বহন করেন হিমালয়ের উচ্চতম চূড়া, এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদার।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকে শুরু হয় ভয়াবহ ইতিহাস বিকৃতি। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে দৈনিক সংবাদপত্র সর্বত্রই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে লেখালেখি শুরু হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও দলিল উপস্থাপন করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
১৯৯৬ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখছে। সীমিত পরিসরে যাত্রা শুরু করলেও অবিরাম তৎপরতা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হাজার হাজার ছবি, স্মারকসহ নানাবিধ দলিল হস্তগত করে জনসাধারণের জন্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ২১ হাজার দলিল (ছবি ও অন্যান্য স্মারক দলিল) সংগ্রহ করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন।
শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়, মুক্তিযুদ্ধের পেছনে পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর এবং তারও আগে ব্রিটিশ আমলের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস সংরক্ষিত আছে এই জাদুঘরে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাবাসীর ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলা, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ, মুজিবনগর সরকার গঠন, মুজিবনগর সরকারের আদ্যপান্ত, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও দলিল, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডসহ ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-দলিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এসবের দলিলে স্থান পেয়েছে পত্রিকার কাটিং, প্রাসঙ্গিক বই এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল নানা উপাদান।
শুধু প্রদর্শনী নয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম জনপ্রিয় ইভেন্ট হচ্ছে আউটরিচ এবং রিচআউট প্রোগ্রাম। ১৯৯৭ সালে শুরু হওয়া আউটরিচ প্রোগ্রামের আওতায় সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলে-মেয়েরা কর্তৃপক্ষের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সফরে আসে। আবার ২০০১ সালে শুরু হওয়া রিচ আউট প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে দুটি বাসকে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ‘ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর’ হিসেবে দেশে নানা আনাচে-কানাচে নিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নয় লাখেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রিচআউট এবং আউটরিচ প্রোগ্রামের দ্বারা উপকৃত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেকটি বড় কর্মসূচি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহ। এ পর্যন্ত ২৮ হাজার মানুষের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার মৌখিক ইতিহাস সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে জাদুঘর প্রশাসন।
একটি আট-সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ শুরু করলে তাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
নতুন ভবনে স্থানান্তরিত জাদুঘরের বিষয়ে এর ট্রাস্টি মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, জনযুদ্ধ যেমন ছিল জনগণের জন্য, এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও জনগণের জন্য’। তিনি আরও বলেন, ‘ইতিহাস আমরা লিখতে চাইনি। সত্য ইতিহাস আমরা মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। আমরা সত্য ইতিহাস উপস্থাপন করে যাব। জয় মানুষ’।
দেশ-বিদেশে যারা এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, কার্যক্রম পরিচালনা এবং নতুন ভবনে স্থানান্তরে অবদান রেখেছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আক্কু চৌধুরী ।
ঢাকাটাইমস/১৫এপ্রিল/এসএএফ/এমআর

মন্তব্য করুন