বেওয়ারিশ পরিচয়ে সমাহিত ‘জঙ্গি’ মারজান, সাদ্দাম

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত সাবেক শিবির নেতা নুরুল ইসলাম মারজান ও এবং জঙ্গি সংগঠন নিউ জেএমবির উত্তরাঞ্চল কমান্ডার সাদ্দাম হোসেনের লাশ স্বজনরা না নেয়ায় দাফন হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে। চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ এই দুই সন্দেহভাজন জঙ্গি নেতার মৃত্যুর কথা জানিয়েছে বাহিনীটি।
রবিবার দুপুরে মারজান ও সাদ্দামকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। এই কাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিল জনকল্যাণমূলক সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। ৫ জানুয়ারি থেকে মরদেহ দুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ছিল। আজ সকালেই তাদেরকে আঞ্জুমানের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় জড়িত ছয় সন্দেহভাজন জঙ্গি, রাজধানীর কল্যাণপুরে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় নিহত নয় জন, নারায়নগঞ্জের পাইকপাড়ায় নিহত নব্য জেএমবির ‘প্রধান’ তামিম চৌধুরীসহ সন্দেহভাজন বেশিরভাগ জঙ্গির পরিচয় প্রকাশ হলেও তারা সবাই সমাহিত হয়েছেন বেওয়ারিশ হিসেবে।
গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে যত সন্দেহভাজন জঙ্গি মারা গেছে তাদের সবাই সমাহিত হয়েছেন বেওয়ারিশ হিসেবে। কারণ তারা জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়েছেন জানতে পেরে স্বজনরা কেউ মরদেহ নিতে রাজি হননি।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সহকারী পরিচালক (সার্ভিস) মাহমুদুল হাসান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা অজ্ঞাত হিসেবে দুইটি লাশ পেয়েছি এবং ওই লাশ দুইটি জুরাইন কবরস্থানে দাফন করেছি।’
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা মারজান এবং তার সহযোগী সাদ্দাম নিহত হন।
শিবির নেতা থেকে জঙ্গি নেতা মারজান
গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় অন্যতম ‘নাটের গুরু’ হিসেবে মারজানকে শনাক্ত করে পুলিশ।
পুলিশের ভাষ্যমতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীরা ওই রেস্টুরেন্টে (হলি আর্টিজানে) বসে যে আইডিতে ছবি ও তথ্য পাঠিয়েছিল সেসব মারজান রিসিভ করেছেন। রেস্তারাঁয় হামলার প্রধান ‘নাটের গুরু’ তামিম চৌধুরী ও হামলাকারীদের মাঝামাঝিতে মারজানের অবস্থান বলে জানিয়েছিলেন পুলিশ।
গুলশানের আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াকেও ‘নাটের গুরু’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল পুলিশ। তাদের প্রত্যেককে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকার পুরষ্কারও ঘোষণা করে পুলিশ।
জঙ্গি হামলার দেড় মাসের মাথায় আগস্টের মাঝামাঝিতে এক জঙ্গির মোবাইল থেকে মারজানের ছবিটি সংগ্রহ করে পুলিশ। এরপর কারাগারে থাকা ও বিচারাধীন অনেক জঙ্গিকে এ ছবি দেখালে তারা এটি মারজান বলে জানায়।
মারজানের গ্রামের বাড়ি পাবনার হেমায়েতপুরের আফুরিয়া গ্রামে। তার বাবা হোসিয়ারি শ্রমিক নিজাম উদ্দিন। পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর মারজান পাবনা শহরের পুরাতন বাঁশবাজার আহলে হাদিস কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এরপর পাবনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাসের পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
গত আগস্টে পুলিশ মারজানের পরিচয় প্রকাশ করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে জানায়, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে আরবি বিভাগের ভর্তির পর থেকেই মারজান শিবিরের রাজনীতিতে জড়ান। এক পর্যায়ে শিবিরের সর্বোচ্চ সাংগঠনিক স্তর সাথীতে পৌঁছে যান তিনি। এই শিক্ষার্থী ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রাখেন। এরপর আর ভর্তি হননি তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. কামরুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মারজান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় এখানকার তালিকাভুক্ত শিবির নেতা ছিলেন। সে ছিল ধুরন্ধর প্রকৃতির। তার সম্পর্কে খোঁজ পেয়ে একাধিকবার অভিযান চালিয়েও ধরতে পারেনি পুলিশ। আমরা যাওয়ার আগেই সব সময় সে সটকে পড়ে।’
দুর্ধর্ষ ছিলেন সাদ্দামও
মোহাম্মদপুরে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত মারজানের সহযোগী সাদ্দাম হোসেনও জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত ছিলেন। তিনি রংপুরের জাপানি নাগরিক হোসি কুনিওসহ কমপক্ষে পাঁচটি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ শাখা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিট। তার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি হত্যা মামলা রয়েছে।।
নিহত হওয়ার আগে সাদ্দাম হোসেনের নাম সেভাবে গণমাধ্যমে আসেনি। তবে তিনিও দুর্ধর্ষ জঙ্গি ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। রংপুরে হোসি কুনিও হত্যা ছাড়াও একই জেলায় মাজারের খাদেম রহমত আলী, বাহাই নেতা রুহুল আমিন, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ মঠের প্রধান পুরাহিত যজ্ঞেশ্বর দাসাধিকারী, কুড়িগ্রামের খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণকারী হোসেন আলীকে হত্যার ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা ছিল বলে জানিয়েছে বাহিনীটি।
এছাড়াও সাদ্দাম গাইবান্ধার চিকিৎসক দিপ্তী হত্যা মামলা, গাইবান্ধার সাঘাটার রাব্বি হত্যা মামলা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে তরুণ দত্ত হত্যা মামলা নীলফামারীর কারবালার খাদেম হত্যা চেষ্টা এবং দিনাজপুরের চিরিবন্দরের চিকিৎসক বিরোন্দ্র হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি ছিলেন সাদ্দাম।
সাদ্দাম হোসেনের গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। তার বয়স আনুমানিক ৩১ বছর। তিনি জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ- জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমান ও রাজশাহীর জেএমবি নেতা সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের সহযোগী ছিলেন। শায়খ রহমানসহ ছয় জঙ্গি নেতার ফাঁসি কার্যকরের পর সাদ্দাম বিভিন্ন অপারেশন চালান।
সাদ্দামের মৃত্যুর দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘উত্তরবঙ্গে যত কিলিং হয়েছে এর সঙ্গে সাদ্দাম জড়িত ছিল। আর মারজান হল এই সমস্ত পরিকল্পনাকারীদের একজন এবং সে একটু উঁচু পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের নেতৃত্ব দিত।’
ঢাকাটাইমস/০৭মে/এএ/ডব্লিউবি

মন্তব্য করুন