ঢামেকের নিউক্লিয়ার মেডিসিনে আসছে ক্যান্সার শনাক্ত যন্ত্র

ক্যান্সারের জীবাণু শনাক্তকরণ ও এই রোগের চিকিৎসাসেবার অত্যাধুনিক যন্ত্র ‘পেট সিটি স্ক্যানার’ যুক্ত হতে যাচ্ছে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সে। ক্যান্সার রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার আগেই শরীরে এর উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যাবে এই যন্ত্রের মাধ্যমে।
এ রকমই একটি যন্ত্র কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিভাগে স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে যুগান্তকারী এই পেট সিটি স্ক্যানার মেশিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনার সব প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন কর্তৃপক্ষ। সবকিছু ঠিক থাকলে দুই-তিন মাসের মধ্যে রোগীরা এর সেবা পেতে শুরু করবে বলে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা মূল্যের পেট সিটি স্কানার মেশিন ক্যান্সার চিকিৎসায় সারা বিশ্বে একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে গণ্য। বছর দুই-তিনেক হলো এ ধরনের মেশিন প্রথম বাংলাদেশে আসে।
পেট সিটি স্ক্যানারের বিশেষত্ব
ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সের পরিচালক অধ্যাপক সানোয়ার হোসেন জানান, রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই পেট সিটি স্কানারে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব, বিশেষ করে ক্যান্সার নির্ণয়। ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা-পরবর্তী সময়ে তাদের দেহে ক্যান্সার জীবাণুর অবশিষ্ট উপস্থিতি থাকা-না থাকাও সম্পর্কেও জানা যায় এই যন্ত্রে।
অন্যান্য পদ্ধতিতে যে ক্যান্সার ধরা পড়ে না তা শনাক্ত করতে যন্ত্রটি কাজ করে। রোগের ধরন নির্ণয় ও কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হবে সেটা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা যায়। সেই সঙ্গে রোগের অবস্থানসহ চিকিৎসাধীন রোগীর উন্নতি সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায় এই যন্ত্রের মাধ্যমে। এই যন্ত্রে চিকিৎসায় তাৎক্ষণিক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
পেট সিটি স্ক্যানের বিশেষত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক সানোয়ার হোসেন বলেন, প্রজিটন এমিশন টমোগ্রাফি কোন টিস্যু মেটাবলিক স্ট্যাস ভিত্তিতে রোগ নির্ণয় করে। প্রচলিত পদ্ধতি শরীরের অঙ্গগুলোর অবস্থানগত স্ক্যান করে। কিন্তু পেট সিটি স্ক্যানার বিপাকীয় অবস্থার ভিত্তিতে রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। ফলে কোনো গঠনগত পরিবর্তনের আগেই আমরা রোগ নির্ণয় করতে পারি।
পেট সিটি স্ক্যানে খরচ
ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন থেকে জানা যায়, আইসোটপ কিনতে হয় বলে পেট সিটি স্ক্যানে বর্তমানে সরকারি খরচ ৩০ হাজার টাকা। অচিরেই সাইক্লোটন চালু করে আইসোটপ সহজলভ্য করার মাধ্যমে এই খরচ অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বেসরকারি হাসপাতালে একটি পেট স্ক্যান করাতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লাগতে পারে বলে জানান তিনি।
অধ্যাপক সানোয়ার হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা জনগণকে সেবা দিতে চাই। ভবিষ্যতে এই সেবা যাতে আরো উন্নত করতে পারি এবং সহজলভ্য করতে পারি সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ রোগীদের চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য করা ও উন্নতমানের চিকিৎসা দেওয়া ছাড়াও উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ঢামেক ক্যাম্পাসের নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেন্টারে প্রতিদিন দুই শতাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি বহুল আলোচিত তৌফা-তহুরার শরীরের আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা এখানেই করা হয়।
বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে কম মূল্যে পরীক্ষা
এখানে যেসব পরীক্ষা করা হয়, তার অনেকগুলো বেসরকারি এমনকি অনেক সরকারি হাসপাতালেও নেই। বেসরকারি হাসপাতালে যেগুলো আছে, তার খরচ তুলনামূলক বেশি। নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সে সরকার নির্ধারিত মূল্যে নিউক্লিয়ার ইমেজিং, যেমন বোন স্ক্যান, কিডনি স্ক্যান, কার্ডিয়াক স্ক্যান, হেপাটোবিলিয়ারি স্ক্যান, ব্রেইন স্ক্যান, লিভার স্ক্যান, পুরো শরীর স্ক্যান, থাইরয়েড স্ক্যান, থাইরয়েড আপটেক, রেনোগ্রাম, বোন ডেনসিট্রোমেট্রি, বিভিন্ন ধরনের হরমোন এনালাইসিস, এবং টিউমার মার্কার, বিভিন্ন ধরনের আলট্রাসনোগ্রাফি, কালার ড্পলার ও থ্রিডি, ফোরডি আলট্রাসাউন্ড, থাইরয়েডের গ্রন্থির বিভিন্ন রোগ যেমন ক্যান্সার, হাইপারথাইরয়াডিজম বা থাইরোটকরকোসিস, হাইপোথাইরয়াডিজম, আইডিডি ও বিভিন্ন ধরনের গলগন্ড রোগ, চোখের কিছু চিকিৎসা, নখের ছত্রাক, বাত ও বাতজাতীয় জয়েন্ট পেইন এবং বোন পেইন প্যালিয়েটিভ থেরাপি ইত্যাদি করে থাকে।
রাজধানীর অভিজাত অ্যাপোলো, ল্যাবএইড, ইউনাইটেড ও মেডিনোভা হাসপাতালে স্বল্প পরিসরে নিউক্লিয়ার মেডিসিন চিকিৎসা রয়েছে। তবে খরচ কয়েক গুণ বেশি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের নিউক্লিয়ার সেন্টারে যে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করাতে লাগে ৩৫০ টাকা, সেটি বেসরকারি হাসপাতালে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। ঢাকা মেডিকেলের এক হাজার টাকার একটি বোস্ক্যান অন্য হাসপাতালে করাতে লাগে সাত-আট হাজার টাকা।
রেডিও আইসোটপ সেন্টার থেকে নিউক্লিয়ার মেডিসিন
১৯৬১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে একটি ছোট টিনেশেড ঘরে ‘রেডিও আইসোটোপ সেন্টার’ নামে যাত্রা করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স ১১তলা নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবন হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে। সারা দেশে ১৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। নিউক্লিয়ার মেডিসিনের এই প্রতিষ্ঠানটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রতিষ্ঠিত একটি বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র ছিল।
(ঢাকাটাইমস/১৮অক্টোবর/মোআ)

মন্তব্য করুন